Advertisement
১৮ মে ২০২৪
‘বর্গি’র ভয়ে ত্রস্ত বাংলা

ভোট লুঠের ছক দেখছে বিরোধীরা

ফের যেন বর্গি আসছে বঙ্গে! ১৮ তারিখ কলকাতার পুরভোটে শাসক দলের বিরুদ্ধে বহিরাগত আমদানি করার অভিযোগ তুলেছিল বিরোধীরা। তাদের বক্তব্য, সেই কাজ করে ‘সফল’ও হয়েছে তৃণমূল। এ বার পালা গোটা রাজ্যের। আগামী শনিবার রাজ্য জুড়ে ৯১টি পুরসভার ভোটে আরও ব্যাপক ভাবে বহিরাগতদের কাজে লাগিয়ে সন্ত্রাস চালানো হবে বলে আশঙ্কা বিরোধীদের। রাজ্য স্তরের এক বাম নেতার কথায়, ‘‘মুর্শিদাবাদ, খড়্গপুরে ভোট করাতে তৃণমূল ঝাড়খণ্ড থেকে লোক ঢোকাবে, শিলিগুড়িতে লোক পাঠাবে দক্ষিণবঙ্গ থেকে— এ বর্গি-হানা নয় তো কী!’’ অভিযোগ নস্যাৎ করে তৃণমূল মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় এ দিন বলেন, ‘‘৩৪ বছর ধরে সিপিএম-ই এই কায়দায় ভোট করেছে। ওরা এখন এ সব বলছে কেন?’’

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:২৭
Share: Save:

ফের যেন বর্গি আসছে বঙ্গে!

১৮ তারিখ কলকাতার পুরভোটে শাসক দলের বিরুদ্ধে বহিরাগত আমদানি করার অভিযোগ তুলেছিল বিরোধীরা। তাদের বক্তব্য, সেই কাজ করে ‘সফল’ও হয়েছে তৃণমূল। এ বার পালা গোটা রাজ্যের। আগামী শনিবার রাজ্য জুড়ে ৯১টি পুরসভার ভোটে আরও ব্যাপক ভাবে বহিরাগতদের কাজে লাগিয়ে সন্ত্রাস চালানো হবে বলে আশঙ্কা বিরোধীদের। রাজ্য স্তরের এক বাম নেতার কথায়, ‘‘মুর্শিদাবাদ, খড়্গপুরে ভোট করাতে তৃণমূল ঝাড়খণ্ড থেকে লোক ঢোকাবে, শিলিগুড়িতে লোক পাঠাবে দক্ষিণবঙ্গ থেকে— এ বর্গি-হানা নয় তো কী!’’ অভিযোগ নস্যাৎ করে তৃণমূল মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় এ দিন বলেন, ‘‘৩৪ বছর ধরে সিপিএম-ই এই কায়দায় ভোট করেছে। ওরা এখন এ সব বলছে কেন?’’

যদিও তৃণমূল সূত্র বলছে, এ বার ভোটে যাওয়া ৯২টি পুরসভার কোনওটিই হাতছাড়া করতে চায় না তারা। দলনেত্রী নিজেই প্রকাশ্যে বিরোধীশূন্য পুরসভা গঠনের ডাক দিয়েছেন। সেই আশা পূরণ করতে স্থানীয় নেতাদের আসন জয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হলে স্বাভাবিক ভাবেই দলে নম্বর কমবে। ফলে কেউই ঝুঁকি নিতে রাজি নন। বিশেষ করে সেই সব এলাকার নেতারা, যেখানে বিরোধীরা এগিয়ে। তাই বাইরে থেকে লোক এনে পুরসভা দখলের ছক কষছেন তাঁরা।

বিরোধীদের অভিযোগ, শাসক দলের সাহস বাড়িয়েছে কলকাতা পুরসভার ভোটে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের অসহায় দশা। ১৪৪ আসনের পুরসভায় তৃণমূল ১০০-র বেশি আসনে জিতবে বলে ভোটের আগেই ইঙ্গিত দিয়েছিল জনমত সমীক্ষা। তার পরেও ‘ঝুঁকি’ নিতে চাননি তৃণমূল নেতৃত্ব। আসন সংখ্যা এবং জয়ের ব্যবধান বাড়াতে মরিয়া ছিলেন তাঁরা। সে জন্য বাইরের লোক আনা থেকে শুরু করে বুথে বুথে দাদাগিরি, সন্ত্রাস কিছুই বাদ যায়নি বলে অভিযোগ। এবং সে দিন ভূরি ভূরি অভিযোগ পেয়েও কোনও ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ-প্রশাসন, এমনকী নির্বাচন কমিশনও। রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায় তো প্রকাশ্যেই কবুল করেছেন, তিনি অসহায়! ফলে তৃণমূলের সাহস আরও বেড়ে গিয়েছে, মনে করছে বাম-বিজেপি-কংগ্রেস।

সিপিএম রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অমিয় পাত্রের বিশ্লেষণ— ‘‘কলকাতায় ভোটের দিন সন্ত্রাস হল। তার পরে চার-পাঁচ দিন ধরে কমিশন বোঝাল তারা কতটা অসহায়। শাসক দল তো সে সুযোগ নেবেই!’’ সূত্রের খবর, চাপ দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন জেলার পুলিশ-প্রশাসনের উপরেও। যাতে ভোটের দিন তারা নিষ্ক্রিয় থাকে। বিরোধীদের অভিযোগ, নানা সুযোগসুবিধার অঙ্কে পুলিশের একাংশ শাসকদলের তল্পিবাহকে পরিণত হয়েছে। এখন স্থানীয় স্তরেও ক্ষমতার হাতবদলের সম্ভাবনায় তারা আতঙ্কিত। সেই কারণেই পুরভোটে শাসক দলের পক্ষে সক্রিয় হয়েছে তারা। উত্তর দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জ এবং ইসলামপুরের পুরভোট প্রসঙ্গে কংগ্রেস নেত্রী দীপা দাশমুন্সিরও দাবি, ‘‘বহিরাগত তো বটেই, পুলিশ-প্রশাসনকে ব্যবহার করেও সন্ত্রাস হতে পারে।’’ যদিও শাসক দল সব অভিযোগই উড়িয়ে দিয়েছে। তাদের বক্তব্য, পরাজয় অবশ্যম্ভাবী বুঝে বিরোধীরা এই অপপ্রচার চালাচ্ছে।

ঘটনা হল, বহিরাগত নিয়ে বিরোধীদের অভিযোগ ঘিরেই এ দিন সরগরম ছিল রাজ্য রাজনীতি। যেমন শিলিগুড়ি। কলকাতা, লাগোয়া শহরতলি, দক্ষিণবঙ্গ, এমনকী, বিহারের কিষানগঞ্জ থেকেও লোক এনে শাসক দল ভোটে সন্ত্রাস করাতে চাইছে বলে দফায় দফায় অভিযোগ করেছে সিপিএম, কংগ্রেস, বিজেপি। বিরোধীদের দাবি, বুধবার সন্ধ্যা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত বাসে, ট্রেনে বহিরাগতদের ঢুকিয়েছে শাসক দল। মূলত নিউ জলপাইগুড়ি, ভক্তিনগর, মাল্লাগুড়ির বিভিন্ন এলাকায় রাখা হয়েছে। ভক্তিনগর এলাকার কয়েক জন তৃণমূল নেতার নেতৃত্বে বুথ-জ্যাম থেকে বুথ দখল, এজেন্টদের তাড়ানো, পাড়ায়-পাড়ায় হুমকি দেওয়ার কাজে তাদের ব্যবহার করা হতে পারে।

শিলিগুড়ি পুরসভায় তৃণমূলের সদস্য সংখ্যা ছিল ১৪। বাম (১৮) এবং কংগ্রেস (১৫) তাদের থেকে এগিয়েছিল। লোকসভা ভোটে আবার ২১টি ওয়ার্ডে এগিয়েছিল বিজেপি। এ কথা মনে করিয়ে দিয়ে দার্জিলিঙের বিজেপি সাংসদ সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়া বলেন, ‘‘দক্ষিণবঙ্গের বহিরাগতদের জড়ো করে ভোট লুঠের পরিকল্পনা করেছে তৃণমূল।’’ শিলিগুড়িতে বামেদের মেয়র পদপ্রার্থী তথা সিপিএম নেতা অশোক ভট্টাচার্যের হুঁশিয়ারি, ‘‘শিলিগুড়ি শান্তিপূর্ণ এলাকা। এখানে সন্ত্রাস করলে তৃণমূল আত্মহত্যা করবে। ভুলে গেলে চলবে না, আগামী বছরও একটা ভোট রয়েছে।’’

প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোকবাবুর আরও অভিযোগ, বহিরাগতদের নিয়ে সন্ত্রাস চালানোর ব্যাপারে বুধবার রাতে পার্থবাবু পুলিশ কমিশনারকে নিয়ে বৈঠক করেছেন। এ প্রসঙ্গে সিপি কোনও মন্তব্য না করলেও পার্থবাবু বলেন, ‘‘পুলিশ-প্রশাসন মুখ্যমন্ত্রী দেখেন। আমি শিক্ষা দেখি। প্রয়োজনে উপাচার্যকে ডাকতে পারি। পুলিশ কমিশনারকে কেন? আর ৯১টা পুরসভায় ভোট হচ্ছে, হঠাৎ শিলিগুড়িতেই বা বহিরাগত আনতে যাব কেন?’’ স্থানীয় মন্ত্রী তথা জেলা তৃণমূল সভাপতি গৌতম দেবের কটাক্ষ, ‘‘হারবে বুঝে বিরোধীদের রামধনু জোট এখন এ সব বলছে।’’

পুলিশ সূত্রের খবর, বুধবার রাতে শিলিগুড়ি ও ভক্তিনগর থানা মিলিয়ে মোট গ্রেফতারের সংখ্যা ৪৩ জন। এর মধ্যে আট জন বহিরাগত। শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনার মনোজ বর্মা বলেন, ‘‘এরা এলাকায় থাকার সন্তোষজনক কোনও কারণ দেখাতে পারেনি। আমরা সমস্ত হোটেল, লজ তো বটেই বাসস্ট্যান্ড, স্টেশন এলাকায় নজর রাখছি, তল্লাশি করছি।’’

একই ছবি দক্ষিণবঙ্গেও। শাসক দল বহিরাগতদের ঢুকিয়ে সন্ত্রাসের ভোট করতে চাইছে— এই অভিযোগ তুলে এ দিন বসিরহাটে ইটিন্ডা রোডে ইছামতী সেতুর সামনে বসে পড়ে স্লোগান দিতে শুরু করেন বিজেপি নেত্রী রূপা গঙ্গোপাধ্যায়। সকাল থেকেই বিক্ষোভ শুরু করেছিলেন বসিরহাটের ২৩টি ওয়ার্ডের বিজেপি প্রার্থী ও কর্মী-সমর্থকেরা। বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যও ছিলেন। বিজেপি নেতাদের ব্যাখ্যা, নভেম্বরে বসিরহাট দক্ষিণ বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে জিতেছেন শমীক। ওই ভোটের ফলে বসিরহাট পুরসভার ২৩টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২০টিতে এগিয়ে বিজেপি। টাকি পুরসভাতেও ১৬টি আসনের মধ্যে ১৪টিতে তারা এগিয়ে ছিল। ফলে, এই সব জায়গায় তৃণমূলের সঙ্গে তাদের কড়া টক্কর হবে।

এই সূত্র ধরে রূপার অভিযোগ, ‘‘কলকাতার মতো ভোট লুঠ করতে শাসক দল রাজারহাট, নিউটাউন এলাকা থেকে লোক নিয়ে আসছে বসিরহাটে। আমাদের কর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। প্রার্থীর মেয়ের হাত ধরে টানা হচ্ছে।’’ আর শমীক বলছেন,
‘‘পুলিশ বহিরাগতদের না-তাড়ালে শুক্রবার রাজ্যপালের কাছে যাব।’’ বহিরাগত আনার অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বসিরহাটের তৃণমূল নেতা দীপেন্দু বিশ্বাস অবশ্য বলেন, ‘‘বিজেপি পায়ের তলার মাটি হারিয়ে ভয় পেয়েছে।’’

বসিরহাট নিয়ে যেমন বিজেপির উদ্বেগ, বামেদের তেমনই চিন্তা সোনামুখী নিয়ে। বাঁকুড়ায় একমাত্র এই পুরসভাতেই ক্ষমতায় রয়েছেন তাঁরা। তাই তৃণমূল সোনামুখী দখলে মরিয়া হয়ে জেলার পাত্রসায়র এবং লাগোয়া জেলা বর্ধমান থেকে ভোটের আগে বহিরাগতদের ঢোকাচ্ছে বলে অভিযোগ সিপিএমের। গত লোকসভা ভোটে এই সোনামুখীতেই ছাপ্পা মারার অভিযোগ উঠেছিল তৃণমূল বিধায়ক দীপালি সাহার বিরুদ্ধে। সেই দীপালিদেবী এ বার পুরভোটের প্রার্থী।

পশ্চিম মেদিনীপুরে ঘাটাল মহকুমার একাধিক পুর-এলাকায় কেশপুর, গড়বেতা এবং হুগলির গোঘাট, খানাকুল থেকে যাওয়া সশস্ত্র বাহিনীকে আশ্রয় দেওয়া হচ্ছে, খড়্গপুরে ঝাড়খণ্ডের দুষ্কৃতীদের নিয়ে আসা হয়েছে— এমনই সব অভিযোগ বিরোধীদের। অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে তৃ‌ণমূলের জেলা সভাপতি দীনেন রায়ের বক্তব্য, ‘‘এই সব বহিরাগত সিপিএমের তৈরি। এখন বিজেপি সিপিএমের কাঁধে চড়ে এই সব অভিযোগ তুলছে।’’

প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর জেলাও সরগরম বহিরাগত-অভিযোগে। জেলায় যে ছ’টি পুরসভায় ভোট, তাদের মধ্যে বেলডাঙা, কান্দি, মুর্শিদাবাদ ছিল কংগ্রেসের, জঙ্গিপুর, জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জ ছিল বামেদের দখলে। একমাত্র ধুলিয়ানে ক্ষমতায় ছিল তৃণমূল। সিপিএমের জেলা সম্পাদক মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য, মুর্শিদাবাদের কংগ্রেস বিধায়ক শাওনী সিংহ রায় প্রায় একই সুরে দাবি করেছেন, ভরতপুর, বড়ঞা, খড়গ্রাম, লালগোলা, ভগবানগোলা, জলঙ্গি, ডোমকলের দুষ্কৃতীদের একাংশকে বিভিন্ন পুরসভা এলাকায় পাঠানোর বন্দোবস্ত করে ফেলেছে শাসক দল। লাগোয়া জেলা বর্ধমান, বীরভূম, এমনকী, ঝাড়খণ্ড থেকেও তারা বহিরাগতদের এনেছে। তৃণমূল অভিযোগ মানেনি।

তবে খোদ অধীর বলেছেন, ‘‘কলকাতার পরে রাজ্যে আরও সন্ত্রাসের ভোট দেখার জন্য রাজ্যবাসী প্রস্তুত থাকুন। তৃণমূল ও পুলিশ যৌথ ভাবে তার পুনরাবৃত্তি ঘটাবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE