Advertisement
E-Paper

দলে দাপট রাখতেই ভোট কাড়ার লড়াই

অধিক সেয়ানায় ভোট নষ্ট! বিধাননগর পুরভোটে দলের মুখ পোড়ার পরে এমনই বলছেন তৃণমূলের রাজ্য নেতৃত্বের একাংশ। দলের ওই প্রথম সারির নেতাদের দাবি, পুরভোটের প্রচারে ও লোকবলে তৃণমূল বিরোধীদের থেকে অনেক এগিয়ে ছিল।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:৫২
পুলিশের সামনেই চলেছে শাসানি। — নিজস্ব চিত্র।

পুলিশের সামনেই চলেছে শাসানি। — নিজস্ব চিত্র।

অধিক সেয়ানায় ভোট নষ্ট! বিধাননগর পুরভোটে দলের মুখ পোড়ার পরে এমনই বলছেন তৃণমূলের রাজ্য নেতৃত্বের একাংশ।

দলের ওই প্রথম সারির নেতাদের দাবি, পুরভোটের প্রচারে ও লোকবলে তৃণমূল বিরোধীদের থেকে অনেক এগিয়ে ছিল। এই যুক্তিতে প্রকাশ্যে বহিরাগতদের দিয়ে ভোট করানোর বিপক্ষেই মত দিয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু সেই যুক্তি অগ্রাহ্য করে বাইরের লোক ঢোকানোর ছক কষেন বিধাননগরে ভোটের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই বহিরাগতদের উপরে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা যায়নি। বেলা বাড়তেই ভোটের রাশ চলে যায় তাদের হাতে।

বিধাননগরে দলের রণকৌশলে অসন্তুষ্ট তৃণমূল নেতাদের বক্তব্য, ভোটের দিন বহিরাগত দুষ্কৃতীদের তাণ্ডব রাজ্যবাসী দেখেছেন। তাতে বিরাট ধাক্কা খেয়েছে দলের ভাবমূর্তি। এখন রাজ্য নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে সেই ক্ষতি কতটা মেরামত করা যাবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।

কিন্তু বহিরাগতদের নিয়ন্ত্রণে রাখা গেল না কেন?

তৃণমূলের একাংশ মনে করছেন, পুরভোটে বহিরাগতের আমদানি এবং দাপাদাপির পিছনে বিধাননগর, রাজারহাট ও নিউটাউন-সহ আশপাশের এলাকায় দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের একটা বড় ভূমিকা আছে। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কথা মাথায় রেখেই কেন্দ্রীয় ভাবে প্রার্থী বাছাইয়ের ঝুঁকি নেননি তৃণমূল রাজ্য নেতৃত্ব। স্থানীয় তিন বিধায়ককে কোটা বেঁধে দিয়ে নিজের নিজের প্রার্থীর নাম পাঠাতে বলা হয়েছিল তৃণমূল ভবনে। এর বাইরে সল্টলেক-নিবাসী এক জেলা নেতাও নিজের পছন্দের প্রার্থীদের নাম পাঠান (চূড়ান্ত তালিকা তৈরির সময় এই জেলা নেতার মতামতই তুলনামূলক ভাবে বেশি গুরুত্ব পায়)। প্রার্থী বাছাইয়ের পরে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়া যথাসম্ভব কমাতে বিধাননগরে প্রকাশ্যে কোনও প্রার্থী তালিকাও ঘোষণা করেনি তৃণমূল। সংশ্লিষ্ট প্রার্থীকে বন্ধ খামে পাঠিয়ে দেওয়া হয় দলীয় প্রতীক।

শাসক দলের অনেকেই এখন বলছেন, কেন্দ্রীয় ভাবে প্রার্থী বাছাই না-করার এই প্রক্রিয়াতেই গলদ ছিল। তাতে বিবাদ তো ঠেকানো যায়নি, উল্টে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে নিজের পাল্লা ভারী রাখার লক্ষ্যে অনুগামীদের জেতাতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন চার বিধায়ক। আর তার জেরেই বহিরাগতদের আমদানি। তৃণমূল সূত্র বলছে, ভোটের আগের রাত থেকে লোক ঢোকানোর প্রতিযেগিতা শুরু হয়ে গিয়েছিল। এক বিধায়ক বেলেঘাটা, দমদম, বরাহনগর ও লেকটাউনের মতো কলকাতা লাগোয়া এলাকা থেকে লোক নিয়ে গিয়েছিলেন। আর এক বিধায়কের অনুগতরা এসেছিলেন মধ্যমগ্রাম, বনগাঁ, হাবড়া, মসলন্দপুর ও অশোকনগরের মতো দূরের এলাকা থেকে। বাকি দুই বিধায়কের ভরসা ছিল বাগুইআটি, রাজারহাট ও নিউটাউনের স্থানীয় ছেলেরাই।

তৃণমূলের একটি সূত্রের খবর, কী ভাবে ভোট করানো হবে ১৫ দিন আগে সেই ছক তৈরি হয়ে গেলেও কোন বুথে কত বাইরের ছেলে বাড়তি ভোট দেবে, তাদের কারা নিয়ন্ত্রণ করবে, সে সব ‘গাইডলাইন’ শেষ পর্যন্ত নিচুতলায় পৌঁছয়নি। ফলে ভোট শুরুর ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে ‘অতিথি শিল্পীদের’ উপরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন ভোট ম্যানেজারেরা। পরে হাজারো ফোনাফুনি করেও নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে আনা যায়নি। ব্যতিক্রম হাতে গোনা কয়েকটি ওয়ার্ড, যেখানে ছক অনুযায়ী নীরবে ভোট করেছে বহিরাগতেরা।

বিধাননগরের ভোট নিয়ে কী পরিকল্পনা ছিল শাসক দলের?

তৃণমূল সূত্র বলছে, ভোটের মূল দায়িত্ব ছিল স্থানীয় তিন বিধায়ক এবং তৃণমূলের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার পর্যবেক্ষক তথা রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের উপরে। এঁদের মধ্যে সুজিত বসু বিধাননগর পুর নিগমের ভোটার নন। দত্তাবাদ-সহ বাইপাস সংলগ্ন সল্টলেকের কিছু ওয়ার্ডের ভোট করাতে তিনি সঙ্গে এনেছিলেন আরও দুই বিধায়ক, বেলেঘাটার পরেশ পাল এবং ভাটপাড়ার অর্জুন সিংহকে— যাঁদের সঙ্গে পুরভোটের কোনও সম্পর্কই নেই। তাঁর এলাকায় ভোট করতে সদ্য জেল থেকে ছাড়া পাওয়া রাজু এবং রবি নস্কর এসেছিল বলে অভিযোগ।

আর এক স্থানীয় বিধায়ক পূর্ণেন্দু বসু ছিলেন বাগুইআটি-কেষ্টপুরের দায়িত্বে। তাঁর সঙ্গে ছিলেন সাংসদ দোলা সেন এবং স্থানীয় অটো ইউনিয়নের নেতা বাবাই বিশ্বাস। তৃতীয় স্থানীয় বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত ছিলেন রাজারহাটের ভারপ্রাপ্ত। সেখানে ১ থেকে ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ভার তিনি দিয়েছিলেন নৈহাটির বিধায়ক পার্থ ভৌমিকের উপরে। ৬ নম্বর ওয়ার্ড দেখতে বলা হয়েছিল কৈখালি চিড়িয়ামোড়ের ‘কলবাবু’কে। বাকি এলাকা ছিল সিন্ডিকেটের চাঁই ডাম্পি-ভজাইদের এক্তিয়ারে।

সল্টলেক এলাকার ভোটের মূল দায়িত্ব ছিল জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের। তিনি আবার ভরসা করেছিলেন বিভিন্ন লোকের উপরে। যেমন, ৪১ এবং ৩২ নম্বর ওয়ার্ডে খাদ্যমন্ত্রীর নিজের দুই প্রার্থীর হয়ে ভোট করানোর ভার ছিল দমদম পুরসভার চেয়ারম্যান-ইন-কাউন্সিল রিঙ্কু দে দত্তর উপরে। তাঁর সঙ্গে দেওয়া হয়েছিল দক্ষিণ দমদমের কাউন্সিলর মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য ও খড়দহ পুরসভার কাউন্সিলর কাজল সিংহকে। এ ছাড়া, অনিতা মণ্ডল ও তুলসী সিংহ রায়কে জেতানোর দায়িত্ব দেওয়া হয় দক্ষিণ দমদমের কাউন্সিলার প্রবীর পাল ওরফে কেটি-কে। খাদ্যমন্ত্রীর আর এক ঘনিষ্ঠ বাণীব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়কে জেতানোর ভার ছিল দক্ষিণ দমদম পুরসভার চেয়ারম্যান-ইন-কাউন্সিল দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপরে। শৈলেন মান্নার মেয়ে নীলাঞ্জনাকেও জেতানোর ভার ছিল পার্ক সার্কাসের তৃণমূল কর্মীদের উপর। প্রাক্তন পুরপ্রধান কৃষ্ণা চক্রবর্তীর হয়ে ভোটে খাটতে লোক এসেছিল মধ্য কলকাতা ও দমদম থেকে।

ভোটের বেশ কিছু দিন আগে থেকেই সল্টলেকের ইসি ব্লকের এক অতিথিশালায় ‘ওয়ার রুম’ তৈরি করেছিলেন খাদ্যমন্ত্রী। সারি সারি গাড়ি আর কর্মী-সমর্থকদের ভিড় লেগেই থাকত সেখানে। ভোটের আগের রাতে সেই অতিথিশালা কার্যত বিয়েবাড়ির চেহারা নিয়েছিল। বরকর্তার মতো সোফায় বসে কাজকর্ম তদারকি করছিলেন জ্যোতিপ্রিয়বাবু। সহায়তায় ছিলেন তিন বিধায়ক নির্মল ঘোষ, তাপস রায় ও সব্যসাচী দত্ত। খাদ্যমন্ত্রীর চোখমুখ ছিল বিধ্বস্ত। সমানে বেজে চলেছে তাঁর পাঁচ-পাঁচটা ফোন। ফোন তুলছেন নিজেই। কর্মী-সমর্থকদের আসা-যাওয়ার খবর নিচ্ছেন আর বলছেন, ‘‘নির্বিঘ্নে সামলাতে হবে পুরোটা। দেখবি যেন গোলমাল না হয়।’’

সেই রাতে খাদ্যমন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন ছিল, এত লোকজনের কী দরকার? জ্যোতিপ্রিয়বাবু জবাব দেন, ‘‘এত বড় ভোট, কিছু কর্মী তো লাগবেই। তবে চিন্তা নেই। বোমা পড়বে না, গুলিও চলবে না।’’ সে রাতেই অনেকটা চ্যালেঞ্জের সুরে মন্ত্রী বলেছিলেন, ‘‘গৌতম দেব চার হাজার লোক ঢোকানোর হুমকি দিয়েছেন। তাই নিজের ‘টিম’ও রাখতে হচ্ছে।’’

কিন্তু খাদ্যমন্ত্রীর টিম শেষ পর্যন্ত তাঁর আস্থার মর্যাদা রাখতে পারেনি। নিজেদের অনুগামীদের জেতাতে দাপিয়ে বেড়িয়েছে অন্য নেতাদের বাহিনীও। তৃণমূলের এক ভোট ম্যানেজারের কথায়, ‘‘আমরা জানতামই না কোথায় কারা ঘাঁটি গেড়েছে। গোড়ায় কিছুটা নিয়ন্ত্রণ থাকলেও পরে তা হাতের বাইরে চলে যায়। যখন বুঝলাম তখন সব শেষ।’’ ভোটের দিন বিধাননগরে থাকা শাসক দলের অন্য এক বিধায়ক জানাচ্ছেন, যে বহিরাগতেরা সে দিন ভিড় জমিয়েছিল, তাদের অধিকাংশের সঙ্গে রাজনীতির যোগ নেই। রাজ্যে পালাবদলের পরে করেকম্মে খাওয়ার জন্যই এরা তৃণমূলে ভিড়েছে। দলের আর এক নেতার কথায়, ‘‘শুধু দলকে জেতানোই নয়, এক গোষ্ঠীর বহিরাগত অন্য গোষ্ঠীর প্রার্থীদের হারাতেও মাঠে নেমে পড়েছিল। ফলে কে কাকে ভোট দিয়েছে, জোর করে বলা যাচ্ছে না।’’

জ্যোতিপ্রিয়বাবু অবশ্য প্রশ্ন তুলেছেন, ‘‘বহিরাগত আনার যাবতীয় অপবাদ আমাদের উপর চাপানো হচ্ছে কেন? কংগ্রেস, সিপিএম, বিজেপি-ও লোক ঢুকিয়েছিল। সংবাদমাধ্যম তাদের আড়াল করছে।’’ কিন্তু কেন এত গোলমাল? খাদ্যমন্ত্রীর জবাব, ‘‘৪১টি ওয়ার্ডের মধ্যে দু’-একটিতে গোলমাল হয়েছে।বাকি কোথাও সমস্যা হয়নি। যদিও সংবাদমাধ্যম সে সব প্রচার করছে না।’’

abpnewsletters over enthusiastic tmc leaders saltlake tmc saltlake vote violence tmc image saltlake voters
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy