Advertisement
E-Paper

‘আমরাই অপরাধী, মেয়েকে বাঁচাতে পারিনি!’

সকলেই চেয়েছিলেন মেয়ে সুখী হোক। সে জন্য মেয়ের বিয়েতে শ্বশুরবাড়ির চাহিদামতো টাকা-আসবাব দিয়েছিলেন। কেউ বা ‘রোজগেরে কন্যা দান’ করেন। কিন্তু তার পরে?

নীলোৎপল বিশ্বাস ও সৌরভ দত্ত

শেষ আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৩:১১

অনেকেরই ভুল ভেঙেছে। বড় দেরিতে।

এখন নিজেদের ‘অপরাধী’ ভাবেন ওঁরা। কিন্তু আগে সচেতন হননি।

সকলেই চেয়েছিলেন মেয়ে সুখী হোক। সে জন্য মেয়ের বিয়েতে শ্বশুরবাড়ির চাহিদামতো টাকা-আসবাব দিয়েছিলেন। কেউ বা ‘রোজগেরে কন্যা দান’ করেন। কিন্তু তার পরে?

মেয়ে সংসারে সুখ পান না। ছোবল মারে আরও পণের দাবি। অসহায় মেয়ে আশ্রয় পান না বাপেরবাড়িতে। গুরুত্ব পায় না তাঁর অভিযোগ। শুনতে হয়, ‘মানিয়ে নে’! মেয়ে ফিরে যান শ্বশুরবাড়ি। এক সময়ে সহ্য ক্ষমতা শেষ হয়। আর তার পরেই সংবাদের শিরোনাম হয়ে ওঠে, ‘পণ দিতে না-পারায় বধূ আত্মঘাতী’ বা ‘পণের জন্য বধূ খুন’!

দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা এই ‘সামাজিক ব্যাধি’র দাওয়াই নিয়ে চিন্তিত সমাজকর্মী, মানবাধিকার কর্মীরা। সরকারি প্রচারও রয়েছে যথেষ্ট। তবু রাজ্যের নানা প্রান্তে ওই ‘ব্যাধি’র শিকার হচ্ছেন বহু মহিলা। মেয়ের মৃত্যুর পরে হুঁশ ফিরছে বাবা-মায়ের। যেমন ফিরেছে কাঁকুড়গাছির শিবানী বেরার। গত বছরের ১৭ অগস্ট মানিকতলার হরিতকী বাগান লেনে শ্বশুরবাড়ি থেকে উদ্ধার হয়েছিল তাঁর মেয়ে, পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা অর্পিতা বেরার ঝুলন্ত মৃতদেহ। তাঁকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার হয় অর্পিতার স্বামী। এখন শিবানীদেবী বলছেন, ‘‘আমরাই অপরাধী। আমরাই মেয়েকে বাঁচাতে পারিনি।’’

কেন এই অনুশোচনা?

শিবানীদেবীর অভিযোগ, বাপের বাড়ি থেকে টাকা আনার জন্য চাপ দেওয়া হতো অর্পিতাকে। শুনতে
হতো গঞ্জনা। ঠিকমতো খেতে দেওয়া হতো না। কন্যাহারা মা মানছেন, ‘‘আমরা ওকে সাহস দিতে পারিনি। বলতাম, একটু মানিয়ে নিতে শেখ। ও নার্সের চাকরি করত। যা রোজগার করত, তাতে ওর দিব্যি চলে যেত। কিন্তু ও যে আমাদের ছেড়ে চলে
যাবে, ভাবিনি।’’

বোনের ক্ষেত্রেও তাঁরা একই ভুল করেছেন বলে মানছেন মানিকতলারই লোহাপট্টির বাসিন্দা দুর্গেশ জয়সওয়াল। একমাত্র বোন নেহা সুখী হবে ভেবে ২০১১ সালের ডিসেম্বরে নগদ, গয়না-সহ প্রায় ২০ লক্ষ টাকা পণ দিয়ে হাওড়ার পঞ্চাননতলায় বিয়ে দিয়েছিলেন দুর্গেশ। তিন মাসের মাথায় ভুল ভাঙল।

আরও পড়ুন: ‘এ বার কার বাবার পালা?’ গো-রক্ষকদের হাতে পুলিশ অফিসারের মৃত্যুতে ছেলের প্রশ্ন

শুরবাড়িতেই আত্মঘাতী হন নেহা। দুর্গেশের কথায়, ‘‘সঞ্জয়রা (নেহার স্বামী) যা চেয়েছিল, দিয়েছিলাম। কিন্তু বিয়ের পরে আরও ১০ লক্ষ টাকা চাইল। বোনকে যাতে মারধর না-করে, সে জন্য কয়েক দফায় এক লক্ষ টাকা দিয়েছিলাম। তাতেও বোনকে রক্ষা করতে পারিনি।’’

বিয়ের আগে পণ, বিয়ের পরে পণ! কেন মেনে নেন বাবা-মা-দাদারা? তাঁদের সেই এক কথা, ‘মেয়ের সুখের কথা ভেবে’। অনেক অভিভাবকই মানছেন, ভাল পাত্র পেতে টাকার কথা তাঁরা প্রথমে চিন্তায় আনেননি। এরপরে আরও টাকার দাবি শুনলেও তাঁরা সেই পুরনো মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। মেয়েকে সাহস জোগানোর পরিবর্তে মানিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দেন। সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অভিজিৎ মিত্র মনে করেন, ‘‘বিয়ে ভেঙে যাওয়াটা অনেক বাবা-মা-ই মেনে নিতে পারেন না এখনও। তাই শ্বশুরবাড়িতে মেয়ে অত্যাচারিত হচ্ছে জেনেও মানিয়ে চলার পরামর্শ দেন। বিয়ে ছাড়া বাঁচার বিকল্প নেই, এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।’’ মানবাধিকার কর্মী কবিতা গুপ্তের মত, ‘‘মেয়ের সমস্যা না-শুনে তাঁকে অবজ্ঞা করলে অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।’’

গত বছরের জুলাইয়ে যেমন ক্ষতি হয়েছে ফুলবাগানের কিশোর সাউয়ের। একমাত্র মেয়ে রূপালি স্বামীর মারধরের কথা জানিয়ে বাবার কাছে থাকতে চেয়েছিলে। কিশোরবাবু সে দিন মেয়ের দায়িত্ব নিতে চাননি। স্বামী এসে রূপালিকে নিয়ে যান। সেই সন্ধ্যায় ফোন পান কিশোরবাবু— ‘পায়েস খাওয়ার পরে মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা উঠে রূপালি মারা গিয়েছে’।

আর মেয়েকে ফেরানোর উপায় ছিল না তাঁর।

Dowry NCRB
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy