Advertisement
E-Paper

মস্তিষ্কের মৃত্যু তরুণের, দ্রুত অঙ্গ দানে গ্রিন করিডর

তামিলনাড়ুর পথে হাঁটল পশ্চিমবঙ্গ। পথ দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত ১৮ বছরের এক তরুণের মস্তিষ্কের মৃত্যু হওয়ার পরে বিন্দুমাত্র সময় না নিয়ে তাঁর অঙ্গদানের সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁর বাবা।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০১৬ ০১:৩৬
স্বর্ণেন্দু রায়

স্বর্ণেন্দু রায়

তামিলনাড়ুর পথে হাঁটল পশ্চিমবঙ্গ।

পথ দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত ১৮ বছরের এক তরুণের মস্তিষ্কের মৃত্যু হওয়ার পরে বিন্দুমাত্র সময় না নিয়ে তাঁর অঙ্গদানের সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁর বাবা। শুধু তা-ই নয়, সেই অঙ্গগুলি অ্যাপোলো থেকে এসএসকেএমে পৌঁছতে যাতে কোথাও ট্র্যাফিকে দেরি না হয়, তার জন্য তামিলনাড়ুর মতোই ‘গ্রিন করিডর’-এর ব্যবস্থা করল কলকাতা পুলিশ। যদিও অঙ্গদানের প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া সারার পরে অঙ্গগুলি এসএসকেএমে রওনা হয় বেশি রাতে। ফলে রাস্তায় তখন যানবাহনের চাপ তেমন বেশি ছিল না। তবু পুলিশের এই উদ্যোগ ও মানসিকতাকে স্বাগত জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। তাঁদের মতে, পুলিশ যে ভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তা অঙ্গদান ও প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে একটা নতুন দিশা দেখাল।

গত রবিবার বসিরহাটে একটি দুর্ঘটনায় গুরুতর জখম হন সেখানকার জামরুলতলা এলাকার বাসিন্দা স্বর্ণেন্দু রায়। প্রথমে বসিরহাট জেলা হাসপাতালে চিকিৎসার পরে স্বর্ণেন্দুর পরিবার তাঁকে কলকাতার অ্যাপোলো গ্লেনেগল্‌স হাসপাতালে ভর্তি করে। বৃহস্পতিবার সেখানে চিকিৎসকেরা ওই তরুণের মস্তিষ্কের মৃত্যু (ব্রেন ডেথ) হয়েছে বলে ঘোষণা করার পরেই স্বর্ণেন্দুর বাবা চন্দ্রশেখর রায় জানিয়ে দেন, সন্তানের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান করতে আগ্রহী তাঁরা। সেই অনুযায়ী খবর যায় স্বাস্থ্য ভবনে। অতিরিক্ত স্বাস্থ্য অধিকর্তা অদিতিকিশোর সাহা দ্রুত আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা নিতে শুরু করেন। স্বাস্থ্য ভবন থেকে খবর যায় লালবাজারের কর্তাদের কাছে। শীর্ষ কর্তারা বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেন, অ্যাপোলো হাসপাতাল থেকে এসএসকেএম পর্যন্ত ১৮ কিলোমিটার রাস্তা গ্রিন করিডর করে নিয়ে আসা হবে অঙ্গগুলি। কোনও সিগন্যালেই গাড়ি আটকাবে না। সেই অনুযায়ী এ দিন সন্ধ্যাতেই প্রত্যেক থানা এবং ট্র্যাফিক গার্ডের অফিসারদের সংশ্লিষ্ট রুটে থাকতে বলা হয়। এর মধ্যে রয়েছে পার্ক সার্কাস সাত মাথার মোড়ের মতো রাস্তাও। সেখানেও পুলিশ কর্ডনের ব্যবস্থা থাকছে।

সেচ দফতরের ঠিকাদার চন্দ্রশেখরবাবু ও সুজাতাদেবীর একমাত্র ছেলে স্বর্ণেন্দু। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে খবর, রবিবার সন্ধ্যায় দ্বাদশ শ্রেণির ওই মেধাবী ছাত্র টিউশন পড়ে ফেরার পথে তাঁর মোটরবাইকের সঙ্গে একটি সাইকেলের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। ছিটকে রাস্তার পাশে বিদ্যুতের খুঁটিতে আছড়ে পড়েন হেলমেটহীন স্বর্ণেন্দু। অ্যাপোলো হাসপাতাল সূত্রে খবর, সোমবার অস্ত্রোপচারের পর থেকে আর জ্ঞান ফেরেনি ওই তরুণের। অনেক চেষ্টার পরে বৃহস্পতিবার চিকিৎসকেরা ঘোষণা করেন ব্রেন ডেথ হয়ে গিয়েছে। কান্নায় ভেঙে পড়েও সঙ্গে সঙ্গেই ওই তরুণের অঙ্গদানের ইচ্ছে প্রকাশ করেন বাবা-মা। এ দিন তাঁর কাকা মানস রায় বলেন, ‘‘আমাদের ছেলের চোখ, লিভার আর কিডনি নিয়ে অন্য কেউ বাঁচুক।’’ অঙ্গদানের পরে একমাত্র ছেলের দেহ বসিরহাটের বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যান চন্দ্রশেখরবাবুরা।

স্বর্ণেন্দুর রক্তের গ্রুপ বি পজিটিভ। সেই অনুযায়ী গ্রহীতা খোঁজা শুরু হয়। তার পরে একটি কিডনি এসএসকেএম, একটি কিডনি অ্যাপোলো, যকৃত এসএসকেএম ও দু’টি চোখ যায় দিশা হাসপাতালে। রাতেই অস্ত্রোপচার হয়। এসএসকেএমে লিভারটি প্রতিস্থাপিত হয় সংযুক্তা মণ্ডলের শরীরে। হাওড়ার সালকিয়ার বাসিন্দা ৪০ বছরের সংযুক্তা গত আট বছর হেপাটিক কোমায় ভুগছেন। প্রতি তিন মাস অন্তর হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় তাঁকে। চিকিৎসক অভিজিৎ চৌধুরীর অধীনে গত মঙ্গলবার ফের ভর্তি হন তিনি। এ দিন দুপুরে জানতে পারেন, লিভার পাওয়া গিয়েছে এবং তা তাঁর সঙ্গে ‘ম্যাচ’ও করেছে। এর আগে লিভার পাওয়া গেলেও ‘ম্যাচ’ করেনি।

মৃতদেহ থেকে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের হারে দেশের অন্য রাজ্যগুলিকে বহু দিনই পিছনে ফেলে দিয়েছে তামিলনাড়ু। ব্রেন ডেথ ঘোষণার কমিটি ও তার পরবর্তী প্রক্রিয়াগুলিতে লাল ফিতের ফাঁস সেখানে প্রায় নেই বললেই চলে। এর পাশাপাশি মৃতদেহ থেকে সংগৃহীত অঙ্গ এক জায়গা থেকে অন্যত্র নিতে যাতে বিলম্ব না হয়, তার জন্য রয়েছে ‘গ্রিন করিডর’। পুলিশে জানালে তারাই ট্র্যাফিকের সমস্যা এড়িয়ে দ্রুত যাতায়াতের ব্যবস্থা করে। যেমন, সংগ্রহ করার চার ঘণ্টার মধ্যেই প্রতিস্থাপিত করতে হয় হৃৎপিণ্ড। মাস কয়েক আগে ভিড়ে ঠাসা ব্যস্ত সময়ে ভেলোরের ক্রিশ্চান মেডিক্যাল কলেজ থেকে ব্রেন ডেথ হওয়া এক তরুণের হার্ট ওই গ্রিন করিডর ধরেই পৌঁছেছিল চেন্নাই মেডিক্যাল কলেজে। সংগ্রহের দু’ঘণ্টার মধ্যেই তা প্রতিস্থাপিত হয় আর এক তরুণের দেহে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, পথ দুর্ঘটনায় গুরুতর আহতদের মস্তিষ্কের মৃত্যুর পরে অঙ্গদান করলে অঙ্গগুলি তুলনায় ভাল থাকে। তাই ওই সব ক্ষেত্রেই অঙ্গদানে পরিবারকে উৎসাহিত করতে চান তাঁরা। এ ক্ষেত্রেও ২০০৮ সালে পথ দেখিয়েছিল তামিলনাড়ু। ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে এক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয় কাঞ্চিপুরমের বাসিন্দা ১৭ বছরের হিতেন্দ্রন সুব্রমনি। তিন দিন ভেন্টিলেশনে রাখার পরে তার ব্রেন ডেথ ঘোষণা করেন চিকিৎসকেরা। তার বাবা-মা দুই চিকিৎসক অশোক সুব্রমনি এবং পুষ্পাঞ্জলি সুব্রমনি এর পরে আর এক মুহূর্তও সময় নেননি। স্থির করেন, একমাত্র সন্তানের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান করবেন। সেই অনুযায়ী, তার দুটি চোখ, কিডনি এবং যকৃতে নতুন জীবন পান পাঁচ জন মানুষ।

হিতেন্দ্রনের পথেই স্বর্ণেন্দু বেঁচে থাকছেন আরও পাঁচ জনের মধ্যে।

Brain dead yout organ Green corridor SSKM Apolo Hospital
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy