Advertisement
০৫ মে ২০২৪
State News

পার্থর ‘ধমক’ খেয়েও বিধায়ক ‘টিটু মস্তানের’ পাশেই!

টিটু লস্করের স্ত্রী রমা গত বারও পঞ্চায়েত ভোটে জয়ী হয়েছিলেন। তবে প্রধান ছিলেন না। এ বার রমাকে প্রধান করার লক্ষ্যে টিটু কোমর বেঁধে নেমেছেন বলে খবর। ভীতিপ্রদর্শন, শাসানি ইত্যাদি চলছে বলে তৃণমূল কর্মীদের একাংশের দাবি।

‘টিটু মস্তান’-কাণ্ডে হস্তক্ষেপ করেছেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

‘টিটু মস্তান’-কাণ্ডে হস্তক্ষেপ করেছেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০১৮ ১৬:৫১
Share: Save:

নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ তৃণমূল। তবু বোর্ড গঠনের আগে এলাকায় সন্ত্রাস কায়েমের অভিযোগ। একটা নাম সন্ত্রস্ত করে রেখেছে আড়ংঘাটা এলাকাকে— শান্তনু লস্কর ওরফে টিটু। অভিযোগ স্থানীয় তৃণমূল কর্মীদেরই একাংশের। স্ত্রী রমা লস্করকে প্রধান করতেই সন্ত্রাস কায়েম করছেন টিটু। অভিযোগ এমনই। খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে রানাঘাট উত্তর-পূর্ব বিধানসভা কেন্দ্র থেকে। দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে স্থানীয় বিধায়ক ধমক খেয়েছেন বলেও জানা গিয়েছে। তা-ও টিটুর দাপট অটুট গোটা এলাকায়।

নদিয়ার আড়ংঘাটা গ্রাম পঞ্চায়েতের ২০টি আসনের মধ্যে ১৭টিতে জয়ী হয়েছে তৃণমূল। গোটা তিনেক আসনে আবার জয় এসেছে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। এই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী প্রার্থীদেরই এক জন রমা লস্কর। স্বামী টিটু লস্করের দাপটেই ১২৭ নম্বর বুথে রমার বিরুদ্ধে কেউ প্রার্থী হতে পারেননি, বলছেন এলাকার তৃণমূল কর্মীদেরই একাংশ। ভোটের আগে যে দাপট টিটু লস্কর দেখিয়েছিলেন, বোর্ড গঠনের আগেও তেমনটাই দেখাতে শুরু করেছেন বলেও অভিযোগ।

টিটু লস্করের স্ত্রী রমা গত বারও পঞ্চায়েত ভোটে জয়ী হয়েছিলেন। তবে প্রধান ছিলেন না। এ বার রমাকে প্রধান করার লক্ষ্যে টিটু কোমর বেঁধে নেমেছেন বলে খবর। ভীতিপ্রদর্শন, শাসানি ইত্যাদি চলছে বলে তৃণমূল কর্মীদের একাংশের দাবি। আড়ংঘাটা পঞ্চায়েতের প্রধান পদে আর কোনও নাম যাতে তৃণমূলের তরফ থেকে প্রস্তাবিত না হয়, টিটু লস্কর তার বন্দোবস্ত বাহুবল দেখিয়ে পাকা করে রাখছেন বলে তৃণমূলের ওই অংশের অভিযোগ।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এই চিঠিই পাঠানো হয়েছে বলে স্থানীয় তৃণমূলকর্মীদের দাবি। —নিজস্ব চিত্র।

শান্তনু লস্কর ওরফে টিটুর বিরুদ্ধে কী অভিযোগ?

অভিযোগের বহর বিস্তর। কেউই প্রকাশ্যে মুখ খুলতে চান না। তবে নাম গোপন রাখার শর্তে অনেকেই মুখ খোলেন। কেউ বলছেন, টিটু লস্করের পরিচিতিই হল ‘গুন্ডা’ হিসেবে। কেউ বলছেন, এক সময়ে সিপিএমের ছাতার তলায় থেকে ‘গুন্ডামি’ করতেন টিটু। ১৯৯৮ সালে আড়ংঘাটায় তৃণমূল অফিসে বোমা হামলার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। অভিযোগ রয়েছে কংগ্রেস এবং তৃণমূলের একাধিক কর্মীকে খুন করারও। ২০০২ সালে আড়ংঘাটা গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্য রতন চক্রবর্তীকে গুলি করা এবং নদিয়া জেলা তৃণমূলের এককালের গুরুত্বপূর্ণ নেতা সমীর নাগের হত্যাকারীদের আশ্রয় দেওয়া— টিটুর ‘কীর্তি’ অনেক রকম, শোনা যাচ্ছে স্থানীয় সূত্রেই। এ ছাড়া আর্থিক অনিয়ম, পূর্ত দফতরের জমি দখল করে বাড়ি করা— টিটু লস্করের বিরুদ্ধে এমন গুচ্ছ গুচ্ছ অভিযোগ নিয়ে ফিসফাস চলছে আড়ংঘাটার তৃণমূল কর্মীদের মধ্যে।

আরও পড়ুন
অভিষেকের মামলা, অমিত শাহকে ব্যাঙ্কশাল কোর্টের সমন

টিটু লস্করের স্ত্রীকে যাঁরা প্রধান হিসেবে চাইছেন না, তাঁরা কাকে চাইছেন? স্থানীয় সূত্রে খবর, তারক বিশ্বাসকে প্রধান পদে চাইছেন তাঁরা। কে এই তারক বিশ্বাস? আড়ংঘাটা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রথম তৃণমূলী প্রধান ছিলেন তারক। তৃণমূল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে যে প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচন, সেই ১৯৯৮-এর ভোটেই জিতেছিলেন তারক বিশ্বাস। প্রধানও হয়েছিলেন সে বছরই। এ বার ফের তারক বিশ্বাস জয়ী হয়েছেন। আড়ংঘাটায় তৃণণূল কর্মীদের অনেকেই চাইছেন তারক বিশ্বাসকে ফের প্রধান করা হোক। কিন্তু, এলাকার বিধায়ক সমীর পোদ্দার খোলাখুলি ভাবেই টিটু লস্করের পাশে দাঁড়িয়ে পড়েছেন।

বিধায়ক টিটু লস্করের পাশে রয়েছেন বলে টিটু-বিরোধীরা হাল ছেড়ে দিয়েছেন, এমন কিন্তু নয়। দলের জেলা নেতৃত্বের কাছে অভিযোগ জানানো হয়েছে। চিঠি দেওয়া হয়েছে দলের মহাসচিব তথা নদিয়া জেলা তৃণমূলের পর্যবেক্ষক পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে। খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছেও চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে স্থানীয় তৃণমূল সূত্রে জানা গিয়েছে।

আরও পড়ুন
ছাত্রমঞ্চ ছেড়ে গেলেন সুরেন্দ্রনাথের অধ্যক্ষ

একজন ‘কুখ্যাত দুষ্কৃতী’র হাতে পঞ্চায়েতের কর্তৃত্ব তুলে দেওয়ায় তৃণমূল কর্মীদের অনেকেরই আপত্তি রয়েছে। অথচ, স্থানীয় বিধায়ক সেই ‘কুখ্যাত দুষ্কৃতী’র হয়ে সওয়াল করছেন— এমন অভিযোগ পেয়েও নেতৃত্ব কি কোনও পদক্ষেপ করছেন না? তৃণমূল সূত্রের খবর, নেতৃত্ব বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট বিচলিত। গত ২৫ অগস্ট পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে অভিযোগপত্র পৌঁছয়। বিষয়টি জেনেই তিনি রানাঘাট উত্তর-পূর্বের বিধায়ক সমীর পোদ্দারকে ফোন করেন বলে খবর। কেন টিটু লস্করের স্ত্রীকে প্রধান করা হবে, কেন তারক বিশ্বাসকে করা হবে না— পার্থবাবু এমনটাও জানতে চান বলে জানা গিয়েছে। তৃণমূল সূত্রের খবর, প্রশ্নের মুখে পড়ে পার্থবাবুকে বিধায়ক সমীর পোদ্দার জানান, তারক বিশ্বাস রাজনীতিই করেন না। পার্থবাবু পাল্টা প্রশ্ন করেন, যিনি রাজনীতিই করেন না, তিনি তৃণমূলের টিকিট পেয়ে ভোটে দাঁড়ালেন কী ভাবে, জিতলেনই বা কী ভাবে? এই প্রশ্নের কোনও সদুত্তর সমীর পোদ্দার দিতে পারেননি।

আরও পড়ুন
এখানে বাঘের বাচ্চারা আছে, বিজেপিকে হুঁশিয়ারি মমতার

সমীর পোদ্দার অবশ্য পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে ধমক খাওয়ার কথা অস্বীকার করছেন। তিনি বলছেন, ‘‘কারা এ সব রটাচ্ছেন জানি না। পার্থ চট্টোপাধ্যায় আমাকে কোনও ধমক দেননি। সবটাই অপপ্রচার।’’ পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ফোন যে তিনি পেয়েছিলেন ২৫ অগস্ট রাতে, তা অবশ্য বিধায়ক অস্বীকার করেননি। তিনি বলেছেন, ‘‘পার্থদা আমার কাছে জানতে চাইছিলেন যে, আমি কী ভাবে প্রধান বেছে নেওয়ার কাজটা করছি? আমি জানিয়েছি যে, সব এলাকাতেই আলোচনার মাধ্যমে প্রধান বেছে নেওয়া হচ্ছে। আমাদের পঞ্চায়েত সদস্যরা যাঁকে চাইছেন বা সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ যাঁকে চাইছেন, তাঁকেই প্রধান করা হচ্ছে।’’

শান্তনু লস্কর ওরফে টিটুর বিরুদ্ধে যে অভিযোগপত্র দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের কাছে পৌঁছেছে, তাকে গুরুত্বই দিচ্ছেন না বিধায়ক। ‘ধমক’ তত্ত্বকে যেমন ‘অপপ্রচার’ বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন, সে ভাবেই ‘কুৎসা’ বলে তিনি উড়িয়ে দিলেন টিটুর বিরুদ্ধে ওঠা যাবতীয় অভিযোগকে। বললেন, ‘‘দীর্ঘ দিন ধরে টিটু আমাদের দলে রয়েছেন। সিপিএমের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, তাই সিপিএম ওঁর নামে অনেক মিথ্যা মামলা দিয়েছিল। এখন আর কোনও মামলা ওঁর নামে নেই।’’ এতেই থামলেন না সমীর পোদ্দার। দরাজ শংসাপত্র দিয়ে বললেন, ‘‘টিটু গোটা আড়ংঘাটা এলাকায় অত্যন্ত জনপ্রিয়। স্থানীয় ব্যবসায়ী সমিতির নির্বাচনে আমরা জিতেছি ওঁর জন্য। ব্যবসায়ীরা ওঁকে সমিতির সম্পাদক করেছেন।’’ বিধায়কের প্রশ্ন, ‘‘টিটু যদি বোমা-গুলি নিয়ে গুন্ডামি করে বেড়াত, তা হলে কি ব্যবসায়ীরা ওঁকে নিজেদের নেতা বানাতেন?’’

তা হলে স্থানীয় তৃণমূল কর্মীদের আপত্তি সত্ত্বেও টিটুর স্ত্রী রমা লস্করই আড়ংঘাটার প্রধান হচ্ছেন? বিধায়ক বললেন, ‘‘ওই পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্যদের অধিকাংশ যাঁকে চাইবেন, তিনিই প্রধান হবেন। ১৭ জনের মধ্যে ১৫ জন যদি রমা লস্করকে চান, তা হলে ২ জনের বিরোধিতায় তো কাজ হবে না।’’ পঞ্চায়েত সদস্যদের নিয়ে আলোচনায় বসেই প্রধানের নাম স্থির করা হবে বলে বিধায়ক জানালেন। তবে ইঙ্গিতপূর্ণ ভাবে বললেন, ‘‘যে ছেলেটার নেতৃত্বে আড়ংঘাটায় আমাদের এত ভাল রেজাল্ট হল, যে ছেলেটা দীর্ঘ দিন ধরে খাটাখাটনি করে, সিপিএমের বিরুদ্ধে লড়ে ওখানে এত ভাল সংগঠন গড়ে তুলল, এখন দায়িত্ব দেওয়ার বেলায় তাঁর কথা না ভাবলে চলবে কী করে! এত লড়াই করল, এত মামলার মুখোমুখি হল। সবই দলের জন্য। এখন দলের লোকেরাই পা টেনে ধরতে চাইছে। এটা মেনে নেওয়া যায় না।’’

নদিয়া জেলা পরিষদের বিদায়ী সভাধিপতি বাণীকুমার রায়ও অসন্তুষ্ট আড়ংঘাটার পরিস্থিতি নিয়ে। খবর তৃণমূল সূত্রের। টিটু লস্করের স্ত্রী প্রধান পদে বসুন, এমনটা সভাধিপতিও চাইছেন না বলে জানা গিয়েছে। তবে বাণীকুমার বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলতে চাইলেন না। বললেন, ‘‘জেলা তৃণমূলের পর্যবেক্ষক পার্থ চট্টোপাধ্যায় হস্তক্ষেপ করেছেন বলে শুনেছি। সুতরাং এ নিয়ে আমার আর কোনও মন্তব্য করা উচিত নয়।’’

(পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাংলায় খবর জানতে পড়ুন আমাদের রাজ্য বিভাগ।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE