Advertisement
০৪ মে ২০২৪
উত্তাল মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল

রোগীর মৃত্যু, বেধড়ক মার চিকিৎসককে

পুজোর ফুল পাড়তে গিয়েছিলেন তিনি। অসুস্থ হয়ে পড়েন হঠাৎই। দেরি না করে তড়িঘড়ি বাড়ির লোক মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যান। কিন্তু হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক বছর পয়তাল্লিশের মিনতি ঘোষকে ‘মৃত’ বলে ঘোষণা করেন। শোকস্তব্ধ পরিবার যখন বাড়ি ফিরে যাওয়ার তোড়জোড় করছে, ঠিক তখনই ঘটল অঘটন। গাড়িতে তোলার সময় নড়ে উঠল ‘দেহ’।

তখনও চলছে চিকিৎসককে মারধর। — নিজস্ব চিত্র

তখনও চলছে চিকিৎসককে মারধর। — নিজস্ব চিত্র

শুভাশিস সৈয়দ
বহরমপুর শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০১৬ ০২:১৩
Share: Save:

পুজোর ফুল পাড়তে গিয়েছিলেন তিনি। অসুস্থ হয়ে পড়েন হঠাৎই। দেরি না করে তড়িঘড়ি বাড়ির লোক মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যান। কিন্তু হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক বছর পয়তাল্লিশের মিনতি ঘোষকে ‘মৃত’ বলে ঘোষণা করেন। শোকস্তব্ধ পরিবার যখন বাড়ি ফিরে যাওয়ার তোড়জোড় করছে, ঠিক তখনই ঘটল অঘটন। গাড়িতে তোলার সময় নড়ে উঠল ‘দেহ’।

এমনটাই দাবি করেছে মিনতি দেবীর পরিবার। তড়িঘড়ি হাসপাতালে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ভর্তি করে নেওয়া হয় রোগীকেও। কিন্তু স্ট্রেচারেই মারা যান মিনতিদেবী। এর পরই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পরিস্থিতি। শুরু হয় ভাঙচুর। এমনকী জরুরি বিভাগের এক চিকিৎসককে বেধড়ক মারধর করা হয় বলেও অভিযোগ। সোমবার সকালের ওই ঘটনার পরে সিভিক পুলিশ কর্মীরা এসে পরিস্থিতি সামাল দিতে এলে তাঁদের সঙ্গেও রোগীর বাড়ির লোকজনের ধস্তাধস্তি শুরু হয়। খবর পেয়ে বিশাল বাহিনী নিয়ে ছুটে আসে বহরমপুর থানার টাউন সাব-ইন্সপেক্টর অঞ্জন বর্মন। গ্রেফতার করা হয় তিন জনকে। বহরমপুর থানার আইসি শৈলেনকুমার বিশ্বাস বলেন, ‘‘চিকিৎসককে মারধর ও হাসপাতালে ভাঙচুর চালানোর অভিযোগে ওই তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ঘটনার তদন্ত চলছে।’’

রোগীর পরিবারের অভিযোগ, গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় মিনতিদেবীকে হাসপাতালে নিয়ে আসা এলে জরুরি বিভাগের চিকিৎসক স্বপন ঘোষ পরীক্ষা করে রোগীর মৃত্যু হয়েছে বলে জানান। চিকিৎসকের কাছ থেকে ওই কথা শুনে হাসপাতাল থেকে ‘দেহ’ বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু করে বাড়ির লোকজন। তখনই গাড়িতে তোলার সময়ে ‘মৃত’ রোগী নড়ে ওঠে বলে পরিবারের লোকজনের দাবি। তাঁরা তখন গাড়ি থেকে নামিয়ে ওই রোগীকে অবিলম্বে হাসপাতালে ভর্তি করানোর জন্য জরুরি বিভাগের ওই চিকিৎসকের উপরে চাপ সৃষ্টি করেন বলে অভিযোগ। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে চিকিৎসক বাধ্য হয়ে রোগীকে ভর্তি করে নেওয়ার জন্য লিখিত নির্দেশ দেন। তখন পরিবারের লোকজন ওই রোগীকে তিন তলায় মহিলা বিভাগে নিয়ে যায়। কিন্তু হাসপাতালের বেডে দেওয়ার আগেই বারান্দায় স্ট্রেচারের মধ্যেই মিনতিদেবী মারা যান। এর পরেই উত্তেজিত রোগীর বাড়ির লোকজন চিকিৎসক স্বপন ঘোষকে বেধড়ক মারধর করে। তারা জরুরি বিভাগে ভাঙচুর চালায় বলেও অভিযোগ। খবর পেয়ে বহরমপুর থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

হাসপাতালের কম্পিউটার, চেয়ার-টেবিল ভাঙচুর করার পাশাপাশি দরকারি কাগজপত্রও লণ্ডভণ্ড করা হয় বলে অভিযোগ। মারের চোটে অসুস্থ হয়ে পড়েন ওই চিকিৎসক। আতঙ্কিত হাসপাতালের অন্যান্য চিকিৎসক-নার্স-কর্মীরা প্রাণভয়ে ছোটাছুটি শুরু করেন। মারের হাত থেকে রেহাই পেতে যে যেখানে পারে লুকিয়ে পড়েন। হাসপাতালে অন্যান্য রোগীর বাড়ির লোকজনের মধ্যেও আতঙ্ক ছড়ায়। সব মিলিয়ে কিছু ক্ষণের জন্য আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়ে যায় হাসপাতাল জুড়ে।

ওই মিনতিদেবী অবশ্য সম্পর্কে রাধারঘাট-১ পঞ্চায়েতের প্রাক্তন প্রধান সিপিএমের কৃপালিনী ঘোষের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়া। কৃপালিনীদেবী জানান, শ্বশুরবাড়ির কাছেই রাধারঘাট এলাকায় বাপুজি ক্লাবের পাশেই বাবার বাড়িতে আমার জা ছিলেন। এ দিন পুজোর জন্য ফুল-বেলপাতা পাড়ার সময়ে আচমকা অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাড়ি ফিরে তাঁর অসুস্থতার কথাও বলেন। ওই কথা শুনে পরিবারের লোকজন তাঁকে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসে। কিন্তু জরুরি বিভাগের চিকিৎসক রোগীকে কোনও রকম পরীক্ষা না করেই মৃত বলে জানান। মৃত রোগী হাসপাতালে নিয়ে আসা হলে নিয়ম অনুযায়ী ময়নাতদন্ত হয়। ফলে রোগী মারা গিয়েছে শুনে পরিবারের লোকজন দ্রুত রোগী নিয়ে বাড়ি চলে যাওয়ার কথা ভাবছিলেন। কৃপালিনীদেবী বলেন, ‘‘গাড়িতে তোলার সময়েও আমার জায়ের নিঃশ্বাস পড়ছিল। ফলে পেট ওঠানামা করছিল। তখন চিকিৎসককে গিয়ে বলার পরে তিনি হাসপাতালে রোগীকে ভর্তির জন্য নির্দেশ দেন। লিফ্‌টে করে তিন তলায় নেমে মহিলা বিভাগে স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়ার সময়ে বারান্দায় রোগীর মৃত্যু হয়।’’ তাঁর অভিযোগ, হাসপাতালে নিয়ে আসার পরেই চিকিৎসা শুরু হলে হয়তো রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হতো। কিন্তু চিকিৎসক কোনও রকম সহানুভূতি দেখাননি।

যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেই চিকিৎসক স্বপন ঘোষ বলেন, ‘‘হাসপাতালে নিয়ে আসার আগেই রোগীর মৃত্যু হয়েছে। আমি পরীক্ষা করেই পরিবারের লোকজনকে জানাই। এমনকী হাসপাতালে মৃত রোগী নিয়ে আসা হলে ময়নাতদন্তের নিয়ম রয়েছে। তাই দ্রুত রোগী নিয়ে হাসপাতাল ছেড়ে চলে যাওয়ার পরামর্শও দিই তাঁদের।’’ তাঁর কথায়, সেই মতো ওরা রোগী নিয়ে চলে যান। তার কিছু ক্ষণ পরেই ফিরে এসে রোগীর বাড়ির লোকজন দাবি করেন যে, রোগী বেঁচে আছে এবং এখনই হাসপাতালে ভর্তি করে নেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করে তাঁরা। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কায় আমি রোগীকে ভর্তি করে নেওয়ার জন্য চিরকুটে লিখে পাঠিয়ে দিই।’’ ওই রোগীর হাসপাতালে ভর্তির কোনও কাগজপত্র কিন্তু তৈরি হয়নি বলে হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে। হাসপাতালের এক কর্মী জানান, জরুরি বিভাগে রোগীকে নিয়ে আসার পরে কয়েক জন জানান রোদে-গরমে ফুল পাড়তে গিয়ে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়েছেন রোগী। আবার কেউ কেউ জানান, সাপে কেটেছে।

মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সুপার মণিময় বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘মৃত্যুর কারণ এখনও স্পষ্ট নয়। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট হাতে পেলে মৃত্যুর সঠিক কারণ বলা সম্ভব হবে। তবে ওই রোগীর পরিবারের কাছ থেকে এখনও পর্যন্ত লিখিত অভিযোগ পাইনি। তবে চিকিৎসকের গাফিলতিতে রোগী মৃত্যু হলে নিয়ম অনুযায়ী বিভাগীয় তদন্ত হয়, এ ক্ষেত্রেও তাই হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE