Advertisement
২০ মে ২০২৪
উইলসন্স ডিজিজ

ওষুধের হাহাকার, সমাধান দূর অস্ত্

পেটের যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন বছর পঁচিশের এক যুবক। পেট ফুলে যাচ্ছিল। মুখটা ক্রমশ বেঁকে যাচ্ছিল। জড়িয়ে যাচ্ছিল কথা। শহরের এক দোকান থেকে আর এক দোকানে ছুটছিলেন ‘উইলসন্স ডিজিজ’-এ আক্রান্ত ওই যুবকের বাড়ির লোকেরা। একটি নির্দিষ্ট ওষুধের আশায়।

প্রতীকী চিত্র।

প্রতীকী চিত্র।

সোমা মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০১:৪৭
Share: Save:

পেটের যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন বছর পঁচিশের এক যুবক। পেট ফুলে যাচ্ছিল। মুখটা ক্রমশ বেঁকে যাচ্ছিল। জড়িয়ে যাচ্ছিল কথা। শহরের এক দোকান থেকে আর এক দোকানে ছুটছিলেন ‘উইলসন্স ডিজিজ’-এ আক্রান্ত ওই যুবকের বাড়ির লোকেরা। একটি নির্দিষ্ট ওষুধের আশায়। কিন্তু কোথাও সেই ওষুধের একটা পাতাও জোগাড় করতে পারেননি তাঁরা। শেষ পর্যন্ত রোগীকে নিয়ে কলকাতা থেকে ছুটতে হল ভেলোরে। কিন্তু সেখানকার ডাক্তারেরাও একই ওষুধের কথা বলেন। কিন্তু ওষুধটি পাওয়া যায়নি ভেলোরেও। ট্রেনে কলকাতা ফেরার পথেই সেপসিস হয়ে যায় ওই যুবকের। দ্রুত একের পর এক অঙ্গ বিকল হতে থাকে। কলকাতায় পৌঁছনোর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মৃত্যু।

দিন কয়েক আগের এই ঘটনা কোনও বিচ্ছিন্ন নজির নয়, উইলসন্স ডিজিজে আক্রান্ত বহু রোগীর ক্ষেত্রেই এই মুহূর্তে এমন পরিণতি ঘটছে। উইলসন্স ডিজিজ আদতে একটি জিনঘটিত অসুখ। এতে আক্রান্ত ব্যক্তির মস্তিষ্কে এবং লিভারে তামা জমতে থাকে। মস্তিষ্কে তামা জমলে ক্রমে তা পার্কিনসন্স ডিজিজের দিকে ঠেলতে থাকে। আর লিভারে জমলে সিরোসিস অব লিভার বা ক্রনিক লিভার ডিজিজ হয়। কখনও কখনও চোখ এবং কিডনিতেও তামা জমে। জমতে থাকা তামা প্রস্রাবের মাধ্যমে শরীর থেকে বার করাটাই এর মূল চিকিৎসা। যে ওষুধের মাধ্যমে তা সম্ভব, তাকে জীবনদায়ী ওষুধ হিসেবেই চিহ্নিত করছেন ডাক্তারেরা। গত তিন মাস ধরে এ হেন একটি জীবনদায়ী ওষুধই এ দেশের বাজার থেকে উধাও।

ওই যুবক যে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে ছিলেন, সেই গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট সুজিত চৌধুরী বলেন, ‘‘দু’মাস আগে রোগটা ধরা পড়েছিল ওই যুবকের। তখন সারা শহর খুঁজে মাত্র এক সপ্তাহের ওষুধ জোগাড় করতে পেরেছিলেন। সম্ভাব্য সব জায়গায় ওঁকে পাঠিয়েছিলাম। কোথাও ওষুধ পাওয়া যায়নি। ওষুধের অভাবে দ্রুত অবস্থার অবনতি হতে থাকে। চেষ্টা করেও ওঁকে বাঁচাতে পারলাম না। এই রোগে আক্রান্ত বহু মানুষ ওষুধের অভাবে ধুঁকছেন।’’

বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছেন, উইলসন্স ডিজিজের আরও একটি ওষুধ রয়েছে। কিন্তু সেটি খুবই দামি এবং এ দেশের বাজারে বিরল। এই পরিস্থিতিতে ডি-পেনিসিলামাইন গোত্রের যে ওষুধটি রোগীদের বড় ভরসা ছিল, সেটাও অমিল। বিভিন্ন দোকানে এই ওষুধের যা স্টক ছিল, ইতিমধ্যেই তার বেশির ভাগ ফুরিয়ে গিয়েছে। ফলে নতুন করে ওই ওষুধ বাজারে না আসা পর্যন্ত বড় সঙ্কটে রোগীরা। যাঁদের রোগ নতুন ধরা পড়ছে, তাঁদের ক্ষেত্রে ওষুধের এমন অভাব কার্যত মৃত্যু-পরোয়ানারই সামিল বলে মত চিকিৎসকদের।

চিকিৎসকদের তরফে ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক এবং ড্রাগ কন্ট্রোলার জেনারেল অব ইন্ডিয়ার কাছে এ ব্যাপারে আবেদন জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে রাজ্য সরকারের হস্তক্ষেপ চেয়ে চিঠি পৌঁছেছে স্বাস্থ্য ভবনেও। ওষুধ বিক্রেতাদের সংগঠন ‘বেঙ্গল কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট অ্যাসোসিয়েশন’ (বিসিডিএ)-ও স্বীকার করেছে, রাজ্যের দোকানগুলিতে এই ওষুধটি পাওয়া যাচ্ছে না। বেশ কয়েকটি সংস্থা এই ওষুধ তৈরি করে। কোনও সংস্থাই ওষুধটির উৎপাদন বন্ধ করার কথা জানায়নি। তা হলে কেন বাজারে তা পাওয়া যাচ্ছে‌ না? একাধিক সংস্থার প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, এ ব্যাপারে তাঁদের অভ্যন্তরীণ কিছু সমস্যা আছে। তা মেটানোর চেষ্টা চলছে।

এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি ওষুধ বাজার থেকে উধাও হওয়ার পরে সরকারের ভূমিকা কী, প্রশ্ন উঠছে তা নিয়ে। স্বাস্থ্য মন্ত্রকের এক কর্তা বলেন, ‘‘আমরা অবিলম্বে এর কারণ এবং কী ভাবে সমস্যাটা মোকাবিলা করা যায়, তার রূপরেখা জানতে চেয়েছি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলির কাছে। অভ্যন্তরীণ সমস্যা থাকলে তারা তা নিজেরা মেটাক। তার খেসারত রোগীরা কেন দেবেন?’’ কত দিনে সমস্যা মিটবে? তিনি বলেন, ‘‘তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে মাসখানেকের মধ্যে একটা সুরাহা হবে বলে আশা করছি।’’

এই একটা মাসও যে কী ভাবে কাটবে, তা ভেবেই হয়রান ডাক্তারেরা। স্নায়ু রোগ চিকিৎসক তথা মুভমেন্ট ডিসঅর্ডার সোসাইটি অব ইন্ডিয়া-র সভাপতি শ্যামল দাস বলেন, ‘‘চোখের সামনে রোগীদের এই কষ্ট, তাঁদের বাড়ির লোকের হয়রানি আর সহ্য করা যাচ্ছে না। চিকিৎসক হিসেবে আমরাও অসহায়।’’ একই কথা গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট অভিজিৎ চৌধুরীর। বৃহস্পতিবার এসএসকেএমে তাঁকে দেখাতে এসেছিলেন ১৮ বছরের রাজু কামিল্যা। কাঁথির বাসিন্দা রাজুও এই অসুখে আক্রান্ত। তাঁর লিভার অকেজো হয়ে পড়ছে। পেটে জল জমছে। খাওয়া কমতে কমতে বন্ধের পথে। অভিজিৎবাবু বলেন, ‘‘চোখের সামনে ছেলেটা নেতিয়ে পড়ছে। কিচ্ছু করতে পারছি না। সমস্যাটা কবে কাটবে, তার কোনও স্পষ্ট দিশাও এই মুহূর্তে আমাদের সামনে নেই।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

medicine patient
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE