গ্রেগ প্যাকারের নাম শোনেননি সাঁইথিয়ার ওই দম্পতি। সাউথ ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের তৈরি ‘লাইন অ্যাঞ্জেল’-এর নামও শোনেননি আসানসোলের সেই কলেজ পড়ুয়ারা।
মোদী সরকারের আর্থিক সার্জিক্যাল স্ট্রাইক কিন্তু তাঁদের এক সারিতেই এনে দিয়েছে! এঁরা সবাই এখন ‘পেশাদার’ লাইন-সিটারের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন!
নিত্য নতুন পণ্য ‘লঞ্চ’ হলেই সবার আগে লাইন দিতেন নিউ ইয়র্কের বাসিন্দা গ্রেগ। ২০০৭-এ আইফোন লঞ্চের সময় নিউ ইয়র্কের ফিফথ অ্যাভিনিউয়ের অ্যাপল স্টোরে তাঁর ১১০ ঘণ্টা আগে থেকে লাইন দেওয়ার কাহিনি খবরের শিরোনামে আসে। পঞ্চাশোর্ধ্ব গ্রেগ এখন পেশাদার লাইন-সিটার হিসেবেই নাম তুলে নিয়েছেন উইকিপিডিয়ায়।
সাউথ ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির পড়ুয়া দুই বন্ধু জ্যানেট ন্যগুয়েন ও ক্রিস একম্যান চালু করেছেন অ্যাপ, ‘লাইনঅ্যাঞ্জেল’! নতুন প্রোডাক্ট লঞ্চ হোক বা সিনেমার টিকিট, অথবা কনসার্ট বা বিশেষ দিনের রেস্তোরাঁ। আপনি চাইলেই পেয়ে যাবেন লাইনে দাঁড়ানোর লোক। ভাড়া? ঘণ্টায় ১৮ ডলার থেকে শুরু। শুধু লাইনঅ্যাঞ্জেলই নয়, লাইনসিটার পাওয়ার এমন বহু অ্যাপ রয়েছে আমেরিকায়।
সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে বাংলার গ্রামগঞ্জে এখন যেন সেই পশ্চিমেরই ছায়া! নোটের আকালে ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড়ানোর জন্য মিলছে ভাড়া করা লাইন-সিটার বা লাইনম্যান!
সাঁইথিয়ার বাসিন্দা এক দম্পতির কথাই ধরা যাক। স্বামী একটি হোটেলে কাজ করেন। স্ত্রী একটি বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করেন। লেখাপড়া জানেন না দু’জনের কেউই। এই বাজারে স্বামী-স্ত্রী দু’জনে মিলেই কাজ থেকে ছুটি নিয়ে লাইন দিচ্ছেন ব্যাঙ্কে। ২০০ টাকা নিয়ে নোট বদলে আনছেন তাঁরা। চেনা লোক হলে ৫০ টাকা! কেন? দম্পতির বক্তব্য, ‘‘চেনা লোকের থেকে কি আর অত টাকা নিতে পারি! ওঁদের অসুবিধাও তো আমরা বুঝি।’’
শিল্প শহর আসানসোলে অবশ্য ‘লাইনের’ দর খানিক বেশি। পুরনো নোট বদলাতে প্রতি হাজারে দিতে হবে পঞ্চাশ টাকা। এমন শর্তেই আসানসোলে লাইন দিচ্ছেন কিছু কলেজ পডুয়া। দাবি করছেন, অল্প টাকায় প্রবীণদের সমস্যা লাঘব হচ্ছে এতে। তাঁদেরও পকেট-মানিতে টান পড়ছে না। তাঁরা বলছেন, ‘‘আমরা তো উপকারই করছি মানুষের। যা সামান্য টাকা নিচ্ছি তা দিয়ে বন্ধুরা খাওয়াদাওয়া করে নেব।’’
দর ওঠানামা করছে লাইনে কত নম্বর আপনি চান তাঁর উপরেও। বীরভূমের দুবরাজপুরের ছবিটাই যেমন। সাত সকাল থেকে লাইন দিচ্ছেন অনেকে। তার পর ‘বিক্রি’ করে দিচ্ছেন জায়গা। প্রথম স্থানের দর উঠছে পাঁচশো পর্যন্ত। তার পর ধাপে ধাপে কমছে। বার্নপুরে আবার ভোর থেকেই লাইনে দাঁড়াচ্ছেন আশপাশের কিছু যুবক। সরাসরি টাকা পাল্টে দেওয়ার বরাত পেলে ভাল, না হলে টাকা নিয়ে লাইনের জায়গা ছেড়ে দিচ্ছেন তাঁরা। টাকা পাল্টে দিতে হলে ‘কমিশন’ একশো টাকা, শুধু ‘লাইন’ কিনতে হলে পঞ্চাশ টাকা। লাইন কিনে হাসিমুখে এক বাসিন্দা বলে ফেললেন, ‘‘সময়ের দাম যে কী, এখন হাড়ে হাড়ে বুঝছি!’’
এক কালে এমন লাইন-সিটারদের দেখা মিলত নানা সরকারি অফিসে। রেলের আগাম টিকিট কাটার কাউন্টারেই হোক বা পাসপোর্ট অফিসের সামনে। এখন সবই অনলাইনে হয়ে যাওয়ায় তাঁরা খানিকটা সিঁটিয়ে গিয়েছিলেন। এত কাল বাদে নোটের আকালে আবার ফিরল লাইনবাবুদের রমরমা! এক তরুণের সরস মন্তব্য, ‘‘অপরেশ লাহিড়ির গান ছিল, লাইন লাগাও, লাইন লাগাও! ওটাই যেন এখনকার থিম সং!’’
সহ প্রতিবেদন: সুশান্ত বণিক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy