পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতীয় সেনার ‘অপারেশন সিঁদুরে’র পরে বিজেপি যখন জাতীয়তাবাদের আবেগ উস্কে সর্বত্র প্রচার চালাচ্ছে, তারই মধ্যে উত্তরবঙ্গে আসছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। পড়শি রাজ্য সিকিমের ভারতভুক্তির ৫০ বছর পূর্তির অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে তার পরে আজ, বৃহস্পতিবার তাঁর আসার কথা আলিপুরদুয়ারে। সরকারি এবং রাজনৈতিক সভা করে যাবেন বিহারে। প্রধানমন্ত্রী রাজ্যে আসার ২৪ ঘণ্টা আগেই থেকেই অবশ্য রাজ্যের শাসক এবং বিজেপি শিবিরে শুরু হয়েছে চাপান-উতোর।
বাংলায় আসার আগেই বুধবার প্রধানমন্ত্রী নিজের এক্স হ্যান্ডলে টেনেছেন রাজ্যের ‘প্রশাসনিক ব্যর্থতা’ এবং তৃণমূল কংগ্রেসের দুর্নীতির প্রসঙ্গ। তিনি লিখেছেন, ‘গত এক দশকে দেশের এনডিএ সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প বাংলার মানুষের কাছে প্রসংশিত হয়েছে। কিন্তু মানুষ তৃণমূলের দুর্নীতি এবং প্রশাসনিক দুর্বলতা দেখে ক্লান্ত’।
প্রধানমন্ত্রীর এই সফরের আগে ‘সর্বধর্ম সমন্বয়ে’র বার্তা দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সঙ্গে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে ‘দুর্যোগ, দুর্ভোগ, হিংসা ও সন্ত্রাস থেকে সকলকে দূরে’ রাখার প্রার্থনাও জানালেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বা তাঁর দলের উল্লেখ মুখ্যমন্ত্রী করেননি ঠিকই তবে মোদীর সফর নিয়ে খোঁচা দিয়েছে তাঁর দল তৃণমূল। প্রধানমন্ত্রীর সফরকে ‘পরিযায়ী পাখির মরসুমী ভ্রমণে’র সঙ্গে তুলনা করে রাজ্যের প্রতি কেন্দ্রীয় বঞ্চনার পুরনো অভিযোগ তুলেছে রাজ্যের শাসক দল।
রাজনৈতিক শিবিরের একাংশ মনে করছে, জাতীয়তাবাদী আবেগে জোর দেওয়া, কেন্দ্রীয় সাফল্যের প্রচারের পাশাপাশি রাজ্যে শিক্ষা ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগকে হাতিয়ার করে বিধানসভা ভোটের হাওয়া তৈরি করতে চাইছে বিজেপি। প্রধানমন্ত্রীর সফর সেই সূত্রেই। তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অন্য অংশ মনে করাচ্ছেন, প্রধানমন্ত্রীর এ বারের সফরের মধ্যে পড়ছে কৌশলগত ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ‘চিকেনস নেক’ এলাকা। ‘চিকেন’স নেক’-এর উপরেই রয়েছে সিকিম এবং শেষ প্রান্তের আগে আলিপুরদুয়ার। এই এলাকায় এসে প্রধানমন্ত্রী কথা বলতে পারেন সামরিক কর্তাদের সঙ্গেও। সাম্প্রতিক সীমান্ত পরিস্থিতি জানতে চাইতে পারেন। আলিপুরদুয়ারের বিজেপি সাংসদ মনোজ টিগ্গা অবশ্য বলেন, “কোনও একটা জায়গা থেকে কাউকে তো শুরু করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী এ রাজ্যে আলিপুরদুয়ার থেকে সেটা শুরু করছেন। প্রশাসনিক সভার পরে প্রধানমন্ত্রীর জনসভাও থাকবে। তাতে দলের নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষও উদ্বুদ্ধ হবেন।”
প্রায় এক বছর পরে দু’টি কর্মসূচি নিয়ে আজ রাজ্যে আসছেন মোদী। তার ঠিক আগে এ দিন দক্ষিণ কলকাতায় একটি পুজোর আয়োজনে উপস্থিত হয়ে মুখ্যমন্ত্রী ইঙ্গিতপূর্ণ ভাবেই রাজ্যের সম্প্রীতি ও সংহতির ঐতিহ্যের কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর সফর বা কোনও রাজনৈতিক দলের কথা উল্লেখ না করলেও তিনি বলেন, ‘বাংলায় মন্দির, মসজিদ, গুরুদ্বার ঐক্যের পথে চলে। এখানে ধর্ম যাঁর যাঁর, উৎসব সবার।’ তবে তৃণমূলের তরফে একাধিক মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর সফর নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে খোঁচা দেওয়া হয়েছে। তৃণমূল বলেছে, ‘পরিযায়ী পাখিরা মরসুমি সফর শুরু করলেন। তাই এলেনই যখন বলেও যান, কেন আটকে রাখা হয়েছে রাজ্যের পাওনা এক লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকা’? হয়েছে।’ রাজ্য সরকার ১০০ দিনের প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেই ওই প্রকল্পে আটকে থাকা টাকা কেন্দ্র থেকে আনতে তিনি ব্যবস্থা নেবেন বলে এ দিনই জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার।
সূত্রের খবর, প্রধানমন্ত্রীর আজ সকালে দিল্লি থেকে বাগডোগরা পৌঁছনোর কথা। সেখান থেকে হেলিকপ্টারে সিকিমের গ্যাংটকে যাওয়ার কথা। দুপুরে হেলিকপ্টারেই তাঁর আলিপুরদুয়ারে পৌঁছনোর কথা। অ্যালিপুরদুয়ার প্যারেড গ্রাউন্ডে প্রথমে সরকারি কর্মসূচি, তার পরে সভা করে হেলিকপ্টারে বিকালে হাসিমারা হয়ে বিশেষ বিমানে তিনি পটনার উদ্দেশে রওনা হতে পারেন। আলিপুরদুয়ারের সভা থেকে বিপিসিএল-এর ‘সিটি গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন’ প্রকল্পের উদ্বোধন করার কথা প্রধানমন্ত্রীর। প্রশাসন সূত্রের খবর, তার পরে জনসভা করবেন মোদী। সভায় কত লোকের জমায়েত হবে তা নিয়ে অবশ্য বুধবারেও চিন্তায় ছিলেন বিজেপি নেতৃত্বের একাংশ।
নাম না করে প্রধানমন্ত্রীকে কটাক্ষ করেছেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী উদয়ন গুহ। কোচবিহারের দিনহাটায় তিনি বলেন, ‘‘কেউ কেউ আগে চায়ের ব্যবসা করতেন। এখন তাঁরা হয়তো কেউ কেউ সিঁদুরের ব্যবসা করছেন। আগে গরম চা বিক্রি করতেন, এখন গরম সিঁদুর তাদের রক্তের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘সেই সিঁদুর বিক্রি করার জন্য একেবারে উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ার পর্যন্ত ছুটে আসছেন।’’ বিধানসভায় বিরোধী দলের সচেতক শঙ্কর ঘোষ পাল্টা বলেছেন, ‘‘ওঁরা তো গোটা রাজ্যকে বেচে দিয়েছেন!’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)