শহরে একের পর এক বহুতল ভেঙে পড়ে, আগুন লাগে। অথচ প্রশাসনের তরফে কোনও সক্রিয়তা দেখা যায় না। শহরে ফের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পরে এই প্রশ্নেই বাধল রাজনৈতিক বিতর্ক।
বড়বাজারের হোটেলে আগুন লেগে দুই শিশু-সহ ১৪ জনের মৃত্যুর সময়ে পুরমন্ত্রী ও কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম ছাড়া রাজ্যের গুরুত্বপূণ সব দফতরের মন্ত্রী ও আধিকারিকেরাই ছিলেন দিঘায় জগন্নাথ মন্দিরের উদ্বোধনে। তার জেরে সরকারের দিকে আও বেশি সমালোচনার তির ধেয়ে এসেছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য জানিয়ছেন, দিঘা থেকেই তিনি মঙ্গলবার রাতভর উদ্ধার কাজের তদারকি করেছেন। মৃতদের পরিবারপিছু দু’লক্ষ এবং আহতদের জন্য ৫০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণও ঘোষণা করেছেন তিনি। একই অঙ্কের ক্ষতিপূরণের ঘোষণা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের তরফেও। দিল্লির এই তৎপরপতাকে আবার কটাক্ষ করতে ছাড়েনি তৃণমূল কংগ্রেস।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বুধবার তাঁর এক্স হ্যান্ড্লে বলেছেন, বড়বাজারের ওই হোটেলে দাহ্য পদার্থ মজুত ছিল বলে প্রাথমিক ভাবে জানা যাচ্ছে। তদন্ত চলছে। পুলিশ ও দমকলের কাজের প্রশংসা করে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, কঠিন পরিস্থিতিতেও ৯৯ জনকে উদ্ধার করা গিয়েছে। তাঁর কাছে প্রাথমিক জমা পড়া রিপোর্ট অনুযায়ী, দমবন্ধ হয়ে অথবা বাঁচার জন্য ঝাঁপ দিতে গিয়ে এত জনের মৃত্যু হয়েছে। পরবর্তী তদন্তের কাজও শুরু করেছে প্রশাসন।
অগ্নিকাণ্ডের পরের সকালেই শোক-প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও। এক্স হ্যান্ড্লে তাঁর বার্তা, ‘কলকাতায় অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানির ঘটনায় আমি শোকাহত। যাঁরা প্রিয়জনদের হারিয়েছেন, তাঁদের প্রতি সমবেদনা। আহতেরা শীঘ্রই সুস্থ হয়ে উঠুন’। সেই সঙ্গেই ক্ষতিপূরণের ঘোষণা করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের তরফে।
তার প্রেক্ষিতে তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষের মন্তব্য, “কী করণীয়, সেটা বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে শেখাতে হবে না। সাত তাড়াতাড়ি প্রধানমন্ত্রী প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন! ক্ষতিপূরণের বিরোধিতা করছি না। কিন্তু এই তাড়াহুড়োর মধ্যে বাংলায় রাজনীতি করার ইঙ্গিতটা বেশি। মণিপুর-সহ অন্যত্র তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায় না। ঝন্টু আলি শেখের জন্য কেন ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করলেন না?”
মদনমোহন বর্মণ স্ট্রিটে অগ্নিকাণ্ডের জায়গায় এ দিন গিয়েছিলেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার, দলের নেতা তাপস রায় প্রমুখ। সুকান্ত সেখানে বলেছেন, ‘‘আগুন লাগা তো বাৎসরিক ঘটনা হয়ে গিয়েছে। এই ঘটনার জন্য একটা বড় আঁতাত দায়ী। এর সঙ্গে রয়েছে স্থানীয় থানা, রাজ্য প্রশাসনের একাংশ এবং পুরসভার মাথারা। ২০২২ সালে লাইসেন্স শেষ হয়ে গিয়েছিল। দেখার দায়িত্ব কার ছিল?’’ তাঁর অভিযোগ, ‘‘যেখানে মানুষের বসতি আছে, জৈন মন্দির আছে, স্কুল আছে। তার পর কোন আইনে এখানে পানশালা তৈরির ছাড়পত্র পাওয়া যায়? এখানে অবৈধ ডালা বসে জোড়াসাঁকো থানাকে পয়সা দিয়ে!’’ সুকান্তের সংযোজন, ‘‘পহেলগামের ঘটনার পরে প্রধানমন্ত্রী-সহ গোটা মন্ত্রিসভা ব্যস্ত। তার পরেও প্রধানমন্ত্রী ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করে দিলেন। তার পরে রাজ্যের টনক নড়ল!’’ রাতেই ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর সরকার। নীলরতন সরকার হাসপাতালের মর্গের বাইরে মৃতদের পরিজনদের সঙ্গে এ দিন তিনি কথা বলতে গেলে পুলিশ বাধা দিয়েছে বলে অভিযোগ।
বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর মতে, ‘‘মর্মান্তিক ঘটনাটি কলকাতার কেন্দ্রে হয়েছে। তবুও দ্রুত পদক্ষেপ কেন করা গেল না? গোটা প্রশাসন ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার দিঘায় তিন দিনের ছুটিতে রয়েছে বলেই কি এমনটা?’’
একই প্রশ্ন তুলেছে সিপিএমও। দলের পলিটব্যুরো সদস্য শ্রীদীপ ভট্টাচার্য, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী, কলকাতা জেলা সম্পাদক কল্লোল মজুমদার-সহ সিপিএমের নেতারা গিয়েছিলেন ঘটনাস্থলে। সুজনের বক্তব্য, ‘‘ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের বলি অন্তত ১৫ জন। মূলত ভিন্ রাজ্যের তাঁরা, মুখ পুড়ছে আমাদের রাজ্যের। বেআইনি নির্মাণ আর সিন্ডিকেট-রাজের অপদার্থতায় এই অবস্থা। এই সময়ে দমকলমন্ত্রী কোথায়? মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দিঘায় উদ্বোধন উৎসবে?’’
দমকলমন্ত্রী সুজিত বসু অবশ্য দাবি করেছেন, “নিয়মিত ‘ফায়ার অডিট’ হয়। কিন্তু পরে শুনলাম, ওখানে ডান্স ফ্লোর বানানো হচ্ছিল। জতুগৃহটা নিজেরাই তৈরি করে। বিপদঘণ্টা বাজেনি। পুরসভা, পুলিশ, দমকল সব দিক খতিয়ে দেখছে। কঠিন পদক্ষেপ করা হবে।”
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)