Advertisement
১৯ মে ২০২৪

চিঠিতে যে নাম ছিল তা-ই লিখেছি, এক রা পুলিশের

এফআইআরে কিশোরীর নাম ‘ধর্ষিতা’ লিখে এখনও অনুতপ্ত নয় পুলিশ। বরং তারা দাবি করে চলেছে, অভিযোগকারীরা যা লিখেছিলেন নিয়ম মেনে সেটাই এফআইআরে তুলে দেওয়া হয়েছে। এতে পুলিশের কোনও দোষ নেই।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০১৬ ০৪:৪২
Share: Save:

এফআইআরে কিশোরীর নাম ‘ধর্ষিতা’ লিখে এখনও অনুতপ্ত নয় পুলিশ। বরং তারা দাবি করে চলেছে, অভিযোগকারীরা যা লিখেছিলেন নিয়ম মেনে সেটাই এফআইআরে তুলে দেওয়া হয়েছে। এতে পুলিশের কোনও দোষ নেই।

নিজ দায়িত্বে এই নাম-বিকৃতি যিনি ঘটিয়েছেন, সেই সাব-ইনস্পেক্টর অতনু পাণিগ্রাহী এখন মুচিপাড়া থেকে হরিদেবপুর থানায় বদলি হয়েছেন। রবিবার তিনি দাবি করেন, ‘‘অভিযোগ দায়েরের চিঠিতে যা তথ্য পেয়েছি, সেটাই এফআইআরে হুবহু তুলে ধরেছি।’’ তাঁর বক্তব্য, যা লেখা আছে, চোখকান বুজে সেটা তুলে দেওয়াটাই নাকি নিয়ম। তিনি নিয়ম পালন করেছেন। আনন্দবাজারের কাছে প্রতিক্রিয়া, ‘‘একটা জিনিস বোঝাতে পারছি না। মূল অভিযোগের চিঠি থেকে আমি এফআইআরে কোনও বদল করতে পারি না।’’ ভাড়াটেদের তরফে পুলিশকে দেওয়া মূল চিঠিটা এ দিন আনন্দবাজারের হাতে এসেছে। হাতে লেখা সেই চিঠিতে কিশোরীর যে নাম লেখা হয়েছে, সেটা পড়ে ‘ধর্ষিতা’ বলে মনে হয়েছিল, দাবি অতনুবাবুর। তিনি সেটাই লিখে দেন। কিশোরীর বাবার অভিযোগ, এ নিয়ে কথা বলতে গেলে ‘তোর মেয়ের নতুন নাম দিলাম’ বলে উপহাসও করেন ওই অফিসার।

এফআইআর-এর প্রতিলিপি পেয়েছিলেন বাড়িওয়ালা বনাম ভাড়াটে বিবাদের অভিযোগকারী এবং অভিযুক্ত পক্ষ উভয়েই। মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ওই কিশোরীর বাবা অভিযুক্ত পক্ষ। তিনি এ দিন বলেন, ‘ধর্ষিতা’ নাম দেখে ভাড়াটে পরিবারের পক্ষ থেকেও মেয়েটিকে বহু টিটকিরি সহ্য করতে হয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘মেয়ের কাছে বিষয়টা চেপে যেতে চেষ্টা করেছিলাম। ভাড়াটেদের টিটকিরি শুরু হতে সব জানাজানি হয়ে গেল।’’ মেয়ের মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করতে না-পেরে তখন তাঁরা রাজ্য মহিলা কমিশনের দ্বারস্থ হন।পুলিশের এ হেন কীর্তিতে রাজ্যের আমলামহল থেকে নারী অধিকাররক্ষা সংগঠনগুলির মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়েছে। কিন্তু এসআই অতনুবাবুর এক রা। তিনি নাকি নিয়মে বাঁধা।

কী বলছে নিয়ম? নিয়ম সত্যি সত্যি মানলে অতনুবাবুর যুক্তি ধোপে টেকে না বলেই অবশ্য কলকাতা পুলিশের অভিজ্ঞ অফিসারদের মত। তাঁদের কথায়, ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫৭ ধারায় বলাই আছে, যে কোনও অভিযোগের আদ্যোপান্ত খতিয়ে দেখে, সব কিছু যাচাই করেই এফআইআর লিখতে হবে। এক প্রবীণ ওসি-র কথায়, ‘‘কেউ যদি এসে বলে সচিন তেন্ডুলকর তার হার ছিনতাই করেছেন, আমরা কি বিষয়টি যাচাই না-করেই লিখব? চিঠির হাতের লেখায় কোনও মেয়ের নাম ধর্ষিতা বলে মনে হল, আর দুম করে এফআইআরে সেটা লিখে দিলাম, তা হয় কখনও?’’ অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্তাদের অনেকে বলছেন, অভিযোগকারী যদি কারও নাম ‘ধর্ষিতা’ লিখেও থাকেন, তবে যে পুলিশ অফিসার এফআইআর নিয়েছেন, বিষয়টি নিয়ে তাঁর সরব হওয়া উচিত ছিল। উচিত ছিল সঠিক নামটি লিখিয়ে নেওয়া। হাতের লেখা বুঝতে না পারলে অভিযোগকারীকে ডেকে জিজ্ঞেস করতে পারতেন তিনি।

প্রাক্তন গোয়েন্দা-কর্তা সমীর গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘যে অফিসার ওই এফআইআর নিয়েছেন তিনি প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্যই নামটি ‘ধর্ষিতা’ লিখেছেন। এই জঘন্য কাজের জন্য ওই অফিসারকে আগে সাসপেন্ড করা উচিত ছিল।’’

সাসপেন্ড তো দূর, লালবাজারের তরফে সরাসরি দুঃখ প্রকাশও করা হয়নি। এক শীর্ষ কর্তা এ দিন বলেন, ‘‘এটা ইচ্ছাকৃত নাকি নিছক ভুল সেটা আমরা খতিয়ে দেখছি।’’ ভাড়াটে যে পরিবার পুলিশের কাছে হাতে লেখা অভিযোগপত্র জমা দিয়েছিল, তাদের দাবি তারা সঠিক নামই লিখেছিল। পুলিশ ভুল করে থাকলে তার দায় তাদের নয়। কিশোরীকে টিটকিরি দেওয়ার অভিযোগও তাঁরা মানতে চাননি। বরং কিশোরীর পরিবারের প্রতি তাঁদের এক গুচ্ছ অভিযোগ রয়েছে। কিশোরীর বাবা বাড়িওয়ালা নন বলেও তাঁদের দাবি।

বাড়িওয়ালা-ভাড়াটে বিরোধে যা-ই ঘটে থাকুক, পুলিশ কী করে কারও নাম ধর্ষিতা বলে লিখে ফেলল এবং তার পরেও নিয়ম নেমে কাজ হয়েছে বলে দাবি করে চলল— সে প্রশ্নের মীমাংসা হচ্ছে না। প্রবীণ পুলিশ-কর্তারা মেনেই নিচ্ছেন, ‘‘সুস্থ মানসিকতার কোনও অফিসার কারও নাম ধর্ষিতা লিখতে পারেন না।’’ সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায় মনে করছেন, এই ঘটনায় পুলিশের নামে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার অবকাশ রয়েছে। রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, এই নামকরণের মধ্যে পুলিশ অফিসারটির হীন দৃষ্টিভঙ্গিই ফুটে উঠেছে। তাঁর কথায়, ‘‘এই মানসিকতা পুলিশে চাকরি করার উপযুক্ত নয়। স্বরাষ্ট্রসচিবের কাছে চিঠি লিখব।’’

মানসিক ঝড়-ঝাপটা পার করে ওই কিশোরী অবশ্য নিজেকে ক্রমশ সামলে নিচ্ছে। আনন্দবাজারে খবরটি প্রকাশিত হওয়ার পরে মেয়েটি এ দিন বলেন, ‘‘যা হওয়ার তো হয়েছে। কিন্তু এটা ভেবে একটু সান্ত্বনা খুঁজে পাচ্ছি, পুলিশের নিচু মানসিকতাটা সবাই জানতে পারল।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

police rape FIR
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE