Advertisement
E-Paper

মেয়েদের ভরসার ক্লাসে ওসি-স্যার

সোজা ক্লাস ইলেভেনের দিকে হেঁটে আসছিল ‘লোকটা’। সাদা জামা-নীল প্যান্ট। হাসি হাসি মুখ। সঙ্গে টিচার ইন চার্জ প্রদ্যোৎ স্যার। ক্লাসরুমে তখন ফিসফাস, ঠেলাঠেলি। ‘‘লোকটা কে রে? বাংলার নতুন স্যার?’’

সুজাউদ্দিন ও সুস্মিত হালদার

শেষ আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০১৬ ০৪:২৩
ক্লাস চলছে। হাঁসখালির ওসি অনিন্দ্য বসু। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য

ক্লাস চলছে। হাঁসখালির ওসি অনিন্দ্য বসু। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য

সোজা ক্লাস ইলেভেনের দিকে হেঁটে আসছিল ‘লোকটা’। সাদা জামা-নীল প্যান্ট। হাসি হাসি মুখ। সঙ্গে টিচার ইন চার্জ প্রদ্যোৎ স্যার।

ক্লাসরুমে তখন ফিসফাস, ঠেলাঠেলি। ‘‘লোকটা কে রে? বাংলার নতুন স্যার?’’

মুর্শিদাবাদের ডোমকল এলাকার কাতলামারি হাই স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক প্রদ্যোৎ প্রামাণিক ওই ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়েই ঢুকে এলেন ক্লাসে। ছাত্রীদের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘‘ইনি আমাদের রানিনগর থানার ওসি, অরূপ রায়। তোমাদের কিছু কথা বলবেন।’’

‘‘আরিব্বাস! লোকটা পুলিশ! আমাদের আবার কী বলবে?’’— ফের শুরু গুনগুন।

মিটিমিটি হাসতে হাসতে অরূপবাবু চক-ডাস্টার নিয়ে এগিয়ে যান ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে। লেখেন নিজের নাম ও মোবাইল নম্বর। তার পর বলেন, ‘‘কোনও রকম বিপদ হলে, বাড়ি থেকে জোর করে বিয়ে দিতে চাইলে কিংবা রাস্তা-ঘাটে কেউ উত্ত্যক্ত করলে সঙ্গে সঙ্গে এই নম্বরে ফোন করবে।’’

ফিসফাস থেমে গিয়েছে। মন দিয়ে ‘নতুন স্যারের’ ক্লাস শুনছে ওরা।

এমনই এক সকালে নদিয়ার বগুলা এইচসিএসসি শ্রীকৃষ্ণ বালিকা বিদ্যাপীঠের নবম শ্রেণিতেও পিন পতনের নৈঃশব্দ। চক-ডাস্টার হাতে পায়চারি করছেন উর্দি পরা এক পুলিশ অফিসার। তিনি হাঁসখালি থানার ওসি, অনিন্দ্য বসু। বাইরে তখন অঝোর বৃষ্টি। ক্লাসরুমে ছাত্রীরা একমনে শুনছে অনিন্দ্যবাবুর ‘গল্প’।

‘‘ফেসবুকে বন্ধুত্ব করবে বুঝেশুনে। দুষ্টু লোকেরা চারপাশে ফাঁদ পেতে রেখেছে। কিছুদিন আগে এমনই এক দুষ্টু লোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে বাড়ি ছেড়েছিল তোমাদের বয়সি এক মেয়ে। এখনও তার খোঁজ মেলেনি। খুব সাবধান।’’ টানা প্রায় ৪৫ মিনিটের ক্লাস। গল্পের মলাটেই চারপাশের নানা বিপদ নিয়ে ওদের সতর্ক করে দিলেন পুলিশ-স্যার। ১৮ বছরের আগে বিয়ে থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়ার বিপদ, প্রতিকারের উপায়— কথা হল সব নিয়েই। অনিন্দ্যবাবুও নিজের মোবাইল নম্বর দিয়ে বললেন, ‘‘দরকার হলেই ফোন কোরো।’’

পড়শি দুই জেলার দুই ‘পুলিশ স্যার’ই জানিয়েছেন, মেয়েদের নিরাপত্তা ও সচেতনতার স্বার্থে নিজের নিজের থানা এলাকার স্কুলগুলিতে এমন ‘স্পেশ্যাল ক্লাস’ জারি রাখবেন তাঁরা। একাধিক সীমান্তবর্তী থানায় কাজ করেছেন অরূপবাবু ও অনিন্দ্যবাবু। দু’জনেই দেখেছেন, কখনও ফেসবুকের ‘বন্ধু’কে বিশ্বাস করে ঘর ছাড়ছে কোনও মেয়ে। কেউ স্কুলে আসতে ভয় পাচ্ছে ইভটিজারদের দৌরাত্ম্যে। এ ছাড়া রয়েছে নিগ্রহ, শ্লীলতাহানি, যৌন হেনস্থা।

ক্লাস চলছে। রানিনগর থানার ওসি অরূপ রায়। ছবি: সফিউল্লা ইসলাম

কিন্তু সমস্যা হল, সে সব ঘটনা সব সময়ে থানা পর্যন্ত আসছে না। কোনও অভিভাবক হয় সচেতনতার অভাব থেকে কিংবা অভাবী পরিবারের ‘বোঝা হালকা’ করতে নাবালিকা মেয়ের বিয়ে দিচ্ছেন। অনেকে আবার ঘরের মেয়ের যৌন হেনস্থা দেখেও সামাজিক লজ্জার কথা বেশি ভাবছেন। তাই ব্যাপারটা চেপে যাচ্ছেন। কিন্তু তাতে অপরাধী তো পার পেয়ে যাচ্ছেই, প্রতিবাদের সাহস হারাচ্ছে মেয়েরাও।

দুই ‘পুলিশ-স্যার’ই তাই বলছেন— ‘‘সচেতনতাই পারে এই সমস্যাগুলোকে নির্মূল করতে।’’ তার ফলও মিলতে শুরু করেছে। ছাত্রীদের ফোন পেয়ে ইতিমধ্যেই বেশ কয়েক জন নাবালিকার বিয়ে ঠেকিয়ে দেওয়া গিয়েছে গিয়েছে। স্কুলের পথে ইভটিজারদের ভিড়ও কমেছে। অরূপবাবু বলছিলেন, ‘‘সব সময়ে সে দিনের মতো সাদা পোশাকে নয়, উর্দি পরেও স্কুলে গিয়ে মেয়েদের ক্লাস নিয়েছি। কোনও অসুবিধে হয়নি।’’ কাতলামারি হাইস্কুলের প্রদ্যোৎবাবু, বগুলার স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষিকা বাসন্তী রায় মানছেন, পুলিশের এই পদক্ষেপ খুব দরকার ছিল। দুই অফিসারের প্রশংসা করেছেন জেলা পুলিশের কর্তারাও। নদিয়ার এসপি শীষরাম ঝাঝরিয়া বলছেন, ‘‘জেলার অন্য স্কুলগুলিতেও আমরা এই ধরনের শিবির করব।’’

ক্লাস শেষে বেরোনোর পথে ‘বড়বাবু’কে থমকে যেতে হয় ছাত্রীদের পিছু ডাকে। সোনালি বিশ্বাস, সুলতানা খাতুনেরা সমস্বরে বলে ওঠে, ‘‘স্যার, আবার আসবেন।’’

Police Classroom Girl's Safety Awareness class
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy