শহর থেকে হবিবপুরের পথে ঢোকা ইস্তক কেবলই কানে আসছিল কথাটা। চায়ের দোকান, গ্রামের দাওয়ার আড্ডায় ফিরে ফিরে আসছিল ‘ওদের’ কথা। গ্রামের সমস্ত কাজেই নাকি ‘ওরা’ সাহায্য করে। সঙ্গে শেখায় ‘সংস্কার’। বস্তুত, সেই সংস্কারের উপর ভর করেই ইদানীং নাকি গ্রামীণ আড্ডায় মেরুকরণ হয়েছে। ধর্মীয় আলোচনা চলছে খুল্লামখুল্লা। এবং তার প্রতিফলন ঘটছে ভোট রাজনীতিতেও। ভোট বাড়ছে বিজেপির।
মালদহ শহর থেকে ঘণ্টাখানেক দূরত্বে প্রথমে পুরাতন মালদহ এবং পরে হবিবপুর। রাস্তা শেষ হয় বাংলাদেশ সীমান্তে। চাঁই মণ্ডল, হালদার এবং সাঁওতাল অধ্যুষিত এলাকায় গত পঞ্চায়েত ভোটে বিজেপির ফল রীতিমতো চিন্তায় ফেলেছে তৃণমূলকে। কিন্তু কোথা থেকে বিজেপির ভোট আসছে, তা নিয়ে সন্দিহান তাঁরা। তৃণমূল নেতা প্রভাস চৌধুরীর যুক্তি, ‘‘সিপিএমের একটা বড় অংশের ভোট গিয়েছে বিজেপিতে।’’ শুধু কি এটাই কারণ?
মালদহে বিজেপির সাধারণ সম্পাদক মানবেন্দ্র চক্রবর্তী স্বীকার করেছেন, সব গ্রামে তাঁদের নেতা নেই। সিপিএমের ভোটও পাচ্ছেন। তবে তাঁর বক্তব্য, ‘‘জেলায় জেলায় মজবুত সামাজিক সংগঠন আছে।’’
বেরনো গেল সেই সংগঠনের সন্ধানে। ভাঙাচোরা রাজ্য সড়ক ডানহাতে ছেড়ে গাড়ি যখন নেমে গেল মেঠো পথে, নিমেষে বদলে গেল সভ্যতার দৃশ্য। নিখাদ জনজাতি অধ্যুষিত গ্রাম। মাটির বাড়ি। চৌকাঠে আলপনা। দেওয়ালে গেরুয়া পদ্মফুল। এক সময় নাকি অধিকাংশ বাড়িতেই ওই পদ্মফুলের জায়গায় থাকত ক্রস। ক্রিশ্চান মিশনারিদের আনাগোনা এখনও আছে। কিন্তু দেওয়াল লিখন বদলাচ্ছে। সপ্তাহে সপ্তাহে হরি সভা বসছে গ্রামে।
গাড়ি পৌঁছল নীল-সাদা লোহার দরজায়। ‘একল’ বিদ্যালয়। শুধু স্কুল? ক্যাম্পাসে আড়াইশো ছাত্র পড়ানো ছাড়াও আছে খেত, বাগান, জল পরিশোধনের প্লান্ট, কাঠ, সেলাইয়ের ওয়ার্কশপ এবং আরও অনেক কিছু। শোনা গেল ১৯৯৮ সাল থেকে রাজ্যের দিকে দিকে ‘একল’ খুলতে শুরু করেছিল সঙ্ঘ। হবিবাপুরের একল তার অন্যতম। জনজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের লক্ষেই এই উদ্যোগ।
একলের পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ মুসাদ্দি বললেন, ‘‘আমাদের কাজ মানুষকে সংস্কারের পথ দেখানো। টোল পদ্ধতির স্কুলে ছাত্ররা দিনের যে কোনও সময় আসতে পারে। আচার্যরা দিবারাত্রি থাকেন। এ ছাড়াও আছে মোবাইল কম্পিউটার ল্যাব। গ্রামে গ্রামে বাস ঘুরে বেড়ায় ছাত্রদের কম্পিউটার শেখাতে।’’ প্রদীপের দাবি, ২০২০-র মধ্যে জনজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলে ‘ঘরওয়াপসি’ সম্পূর্ণ করবেন তাঁরা।
একলের রাজ্য সভাপতি কৃষ্ণেন্দু দত্তের বক্তব্য, পশ্চিমবঙ্গে সব মিলিয়ে অন্তত সাড়ে তিন হাজার একল আছে। এছাড়াও কাজ করছে ‘বনবাসী কল্যাণ আশ্রম’এর মতো সংগঠন। পড়াশোনা থেকে মৃতদেহের সৎকার— সব কাজে গ্রামের মানুষের পাশে থাকেন তাঁরা।
এই কর্মকাণ্ডের কথা কি জানা আছে জেলার অন্য রাজনৈতিক দলগুলির? তৃণমূলের হবিবপুর ব্লক সভাপতির বক্তব্য, ‘‘ওরা কী সব প্রাণায়ম-টানায়ম করায় শুনেছি।’’ আর প্রবীণ সিপিএম এবং চাঁই মণ্ডল আন্দোলনের নেতা অবণী মণ্ডলের কথায়, ‘‘লোকে বলছেন, সিপিএমের ভোট বিজেপিতে যাচ্ছে। কিন্তু যাওয়ার কারণটা কেউ বিশ্লেষণ করছেন না। সামাজিক স্তরে সঙ্ঘ পরিবার মেরুকরণ করে ফেলেছে।’’
রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের ব্যাখ্যা, ষাট-সত্তরের দশকে সিপিএম যেমন গণ সংগঠনের মাধ্যমে মানুষের জীবনচর্যায় ঢুকে পড়ত। বিজেপি-ও কুড়ি বছর ধরে সামাজিক সংগঠনের আড়ালে তাদের জনভিত্তি তৈরি করেছে। সংঘ পরিবারের সামাজিক সংগঠন, বিশেষত তফশিলি জাতি-উপজাতি অঞ্চলে গত ২০-২৫ বছর ধরে সক্রিয়। বছরকয়েক আগে রাজ্য সভাপতি নির্বাচিত হয়েই আড্ডার ছলে দিলীপ ঘোষ বলেছিলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে কুড়ি-পঁচিশ বছর ধরে সামাজিক ভিত্তি তৈরি করেছে সংঘ। যে চারা রোপন করা হয়েছে, অদূর ভবিষ্যতে তা ফলদায়ী হবে।’’ একল দিলীপবাবুর কথা মনে পড়িয়ে দিল।