বন্যপ্রাণী শিকার আদিবাসীদের প্রাচীন রীতি। শিকারের জন্য জঙ্গলে আগুন দেওয়ার চলও ছিল। সচেতনতার ছোঁয়ায় সেই ছবিটা এখন অনেকটাই বদলেছে। আর সেই বদলের রেশ রেখেই আদিবাসী মহিলাদের আঁকা দেওয়াল চিত্রেও ফুটে উঠছে জঙ্গল ও বন্যপ্রাণ বাঁচানোর বার্তা।
বাঁদনা ও সহরায় উৎসব উপলক্ষে প্রতিবার সেজে ওঠে পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ের বিভিন্ন গ্রামের দেওয়াল। ছাতনি, কমলাবহাল, ইচাকোটা, তালাকদহর প্রভৃতি গ্রামের মহিলাদের আঁকা দেওয়াল চিত্রের মান বেশ ভাল। লালমাটি, গাছগাছালির পাতা-ফুল বেটে তাঁরা রং বানান। ইদানীং বাজার থেকে রং কিনেও ছবি আঁকছেন কেউ কেউ। সাধারণত গরু কিংবা কাড়া খুঁটা (গরু বা পুরুষ মোষের সঙ্গে মানুষের লড়াই), আলপনা আঁকা হয়। কিন্তু এ বার ইচাকোটা গ্রামের কয়েকটি দেওয়ালে মহিলারা সচেতনতার ছবি এঁকেছেন।
একদা অরণ্যচারীদের জীবনযাত্রা এখন আমূল বদলেছে। তবে প্রথা বাঁচিয়ে রাখতে এখনও বছরের নির্দিষ্ট দিনে অযোধ্যা পাহাড়ে শিকার উৎসবে যোগ দেন আদিবাসী সমাজের পুরুষেরা। কয়েক বছর আগেও ময়ূর, শুয়োর শিকার হয়েছে। তবে বন দফতর ও পুলিশের প্রচার, নজরদারিতে এখন শিকার করা প্রায় বন্ধ। তবে শীতকালে জঙ্গলে দুষ্কৃতীদের অগ্নিসংযোগের ঘটনা বেড়েছে। তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গাছপালা, পশু-পাখি।
তাই মহিলাদের দেওয়াল চিত্রে সচেতনতার বার্তা জরুরি। ইচাকোটার দেওয়ালে আঁকা— কয়েকজন শিকারি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে জঙ্গলে যাচ্ছেন। তাঁদের বুঝিয়ে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করছেন দুই প্রবীণ। অন্য একটি দেওয়ালের ছবিতে জঙ্গলে আগুন না দেওয়ার বার্তা। ছবিগুলি এঁকেছেন স্থানীয় বধূ সুমিতা টুডু ও পার্বতী হেমব্রম। ছেলেবেলায় আঁকা শিখতেন জানিয়ে মাধ্যমিক উত্তীর্ণ দুই তরুণী বললেন, ‘‘প্রতিবার
আলপনা আঁকি। এ বার মনে হল, জঙ্গলে শিকার কমলেও পুরো বন্ধ হয়নি। বনকর্মীরা আমাদের সহায়তা চান। তাই ভাবলাম, জঙ্গল ও জীবজন্তু বাঁচানোর বার্তা দেওয়া ছবি আঁকলে কেমন হয়!’’
লোকগবেষক সুভাষ রায় বলেন, ‘‘উৎসবের মধ্যে দিয়ে সামাজিক সচেতনতার যে বার্তা মহিলারা দিচ্ছেন, তা প্রশংসনীয়।’’ আদিবাসী সংগঠন ‘ভারত জাকাত মাঝি পারগানা মহলে’র পুরুলিয়া জেলা পারগানা রতনলাল হাঁসদারও বক্তব্য, ‘‘পশুপাখিদের রক্ত ঝরুক আমরাও চাই না। সেই বার্তা নিয়ে মহিলাদের এগিয়ে আসাকে সাধুবাদ জানাচ্ছি।’’ অযোধ্যাপাহাড়ের বাসিন্দা অখিল সিং সর্দার, সন্দীপ লায়ারা জানালেন, সাবেক ছবির পাশাপাশি নতুন ধরনের ছবিও মন্দ লাগছে না।
বন দফতরের মতে, এ সবই সচেতনতার প্রচারের ফল। পুরুলিয়ার ডিএফও অঞ্জন গুহের কথায়, ‘‘বন ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় সচেতনতার প্রচারে নারীশক্তি এগিয়ে এলে তার থেকে ভাল কিছু হয় না। ওঁদের এই ভাবনাকে কুর্নিশ জানাই।’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)