Advertisement
E-Paper

পাঁচ বছরেও ধরা গেল না পরিতোষকে

তারাপীঠ মন্দিরে আরতি সবে শেষ হয়েছে। সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা। হেমন্তকাল। বাতাসে হালকা শীতের আমেজ। আরতি দেখে লজ কিংবা হোটেলের পথ ধরেছেন অনেকেই। তারাপীঠের দ্বারকা সেতুর উপরে তখন এত আলো ছিল না।

অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৭ জুন ২০১৬ ০৭:৪৯

তারাপীঠ মন্দিরে আরতি সবে শেষ হয়েছে। সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা। হেমন্তকাল। বাতাসে হালকা শীতের আমেজ। আরতি দেখে লজ কিংবা হোটেলের পথ ধরেছেন অনেকেই। তারাপীঠের দ্বারকা সেতুর উপরে তখন এত আলো ছিল না। আর পাঁচ জনের মতো কৃষ্ণনগরের সাতাশ বছরের যুবক অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ওরফে নসু এবং তাঁর সঙ্গী কোয়েল মণ্ডল (নাম পরিবর্তিত) তারাপীঠের দ্বারকা সেতুর দিয়ে হেঁটে ফিরছিলেন। একটু আগে আগে হাঁটছিলেন অন্য সঙ্গী রমেশ সিংহ, বুবাই সরকাররা। কিছুটা পিছনে কোয়েল।

এমনই এক সময়ে হঠাৎই খুব কাছ থেকে ছুটে এল গুলি। মুহূর্তে একটা আর্তনাদ করে রাস্তাতেই পড়ে গেলেন অরূপ (২৭)! রমেশ ও বুবাইরা পিছনে ফিরতেই দেখেন ধোঁয়ায় ছেয়ে গিয়েছে চারপাশ। আকষ্মিকতা কাটিয়ে পড়িমড়ি করে ছুটতে শুরু করেছেন দ্বারকা সেতুর উপরে থাকা দর্শনার্থী, স্থানীয় বাসিন্দারা। বন্ধ হতে শুরু করেছে দোকানপাঠ। ঘটনাস্থল থেকে ১০০ মিটার দূরে তারাপীঠ ফাঁড়ি (এখন থানা)। চলে এসেছে পুলিশ। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগেই মৃত্যু হয় অরূপের। হাসপাতাল সূত্রে জানানো হয়, বুকের বাঁ দিকে ও পিঠে খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণেই মৃত্যু।

২০১১ সালের ১৫ নভেম্বরের ঘটনার পরে কেটে গিয়েছে পাঁচ পাঁচটি বছর। এখনও অধরা মূল অভিযুক্তই। নদিয়া জেলা পুলিশের দাবি, মূল অভিযুক্ত পরিতোষ দত্ত ফেরার। এমনটাই জানেন মৃতের পরিজনেরাও। সেই সূত্রেই উঠে আসছে পুলিশের গাফিলতির প্রসঙ্গ।

এ দিকে ঘটনার পরে নিহত যুবকের সঙ্গীদের আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে পুলিশ। তখনই খোঁজ পড়ে সঙ্গী কিশোরীর। কোথায় গেল সে? সঙ্গীরা জেরায় জানায়, ঘটনার পর থেকেই বছর চোদ্দোর কোয়েল বেপাত্তা। তারাপীঠ ফাঁড়িতে খবর সংগ্রহে আসা সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের থেকে পুলিশ জানতে পারে কালো জিনসের উপরে সাদা টপ পরা এক অল্পবয়সী মেয়ে একা একটি রিকশায় চেপে কিছুক্ষণ আগে তারাপীঠ থেকে যেতে দেখা গিয়েছে। তারাপীঠ থানার এক এএসআই মোটরবাইকে সঙ্গে সঙ্গে তরুণীর খোঁজে বেরিয়ে পড়েন। ইতিমধ্যে খবর গিয়েছে মৃতের বাড়িতে। রাতেই তারাপীঠে পৌঁছন পরিজনেরা। জামাইবাবু মৃন্ময় পাল মাড়গ্রাম থানায় নাজিরপুরের পরিতোষ দত্ত (হাত কাটা পরি নামে এলাকায় পরিচিত), বাবুসোনা শর্মা (কোতয়ালি থানার কালিনগরের বাসিন্দা), নীতিশ ও আপ্পু এবং বরানগরের ৬ নম্বর কেদার বন্দ্যোপাধ্যায় লেনের বাসিন্দা রাজেশ সামন্ত ওরফে রাজেশ মল্লিকের নামে খুনের অভিযোগ দায়ের করেন। রাতেই পুলিশ রামপুরহাট স্টেশন লাগোয়া এলাকা থেকে কোয়েল এবং রাজেশ সামন্তকে গ্রেফতার করে। তাঁদের কাছ থেকে মেলে হাওড়ার যাওয়ার ট্রেনের টিকিট। জেরায় রাজেশ ও কোয়েল দু’জনেই খুনের কথা স্বীকার করে নেয় বলে পুলিশের দাবি। তদন্তকারী এক পুলিশকর্তার কথায়, ‘‘কৃষ্ণনগরের নাজিরপুরের বাসিন্দা পরিতোষ দত্তের কথায় তাঁরা খুন করেছে বলে জবানবন্দী দেয়।’’ তাঁর কথায়, তাতে দু’জনেরই আলাদা আলাদা স্বার্থ ছিল বলে জানা যায়। তবে সেটা কী, সে প্রশ্নে ধোঁয়াশা ছিল পুলিশের। এক পুলিশ কর্তার কথায়, ‘‘এই দু’জনকে পরিতোষ নিজের শরীরে গুলির দাগ দেখিয়ে বলেছিল সেই ক্ষতের জন্যে দায়ী অরূপ। তারপরেই কোনও ভাবে সাহায্যের ব্যাপারে রাজি করিয়ে ফেলেছিল।’’

২০১১ সালে তারাপীঠে গুলিতে খুন হন কৃষ্ণনগরের যুবক।

নিহত যুবকের নাগাল পেতে বছর চোদ্দোর এক কিশোরীকে কাজে লাগানো হয় বলে অভিযোগ।

প্রধান অভিযুক্ত এখনও ফেরার। ধৃত নাবালিকার বিচার চলছে জুভেনাইল আদালতে। এখন জামিনে মুক্ত।

পুলিশ তদন্তে জানতে পারে, পরিতোষ জব্দ করতে চেয়েছিল অরূপকে। এই কাজে পূর্ব পরিচিত কোয়েলকে সে প্রথমে মাঠে নামায়। অরূপের মোবাইল নম্বর দিয়ে যোগাযোগ করতে বলে। জেলা পুলিশের এক কর্তার কথায়, ‘‘কোয়েলও কথা মতো কাজ করে গিয়েছে। প্রেমের অভিনয় করেছে। এমনকী একসঙ্গে তারাপীঠেও যায়।’’ তিনি জানাচ্ছেন, গোটা পর্বে কোয়েলকে নজরে রেখে গিয়েছে রাজেশ। কোয়েলই অরূপের সমস্ত গতিবিধি ফোনে জানত রাজেশকে। পুলিশ সূত্রের খবর, ১৫ নভেম্বর দুপুরে কৃষ্ণনগর থেকে অরূপ চার জন বন্ধুকে নিয়ে তারাপীঠ আসছে এবং তাঁদের সঙ্গে কোয়েলও থাকবে সে খবরও কোয়েলই রাজেশকে দেয়। সেই মতো রাজেশ, পরিতোষ এবং তাঁদের দুজন সঙ্গী কোয়েলকে গাড়িতে করে চাপিয়ে বহরমপুরে নিয়ে আসে। সেখানে পৌঁছে কোয়েল অরূপকে ফোনে জানায় সে বহরমপুর সেতুর কাছে দাঁড়িয়ে থাকবে। অরূপদের গাড়ি সেই মতো পায়েলকে তুলে নেয়। অরূপদের গাড়ি তারাপীঠের উদ্দেশে রওনা হলে গাড়ি অনুসরণ করে পরিতোষদের গাড়িও তারাপীঠে চলে আসে। তারপরেই পরিকল্পনা মতো ওই ঘটনা!

পুলিশি তদন্তে জানা গিয়েছে, অরূপ পুজো দিয়ে বেরনো থেকে শুরু করে মন্দির যাওয়ার রাস্তা বা দ্বারকা সেতু, পুরো সময়টাই ছায়াসঙ্গী ছিল পায়েল। সেতুতে ওঠার খবরও রাজেশকে ফোনে জানায় কোয়েল। জেলা পুলিশের ওই কর্তার দাবি, ‘‘তারপরেই অরূপকে কাছ থেকে গুলি করে রাজেশ। কিন্তু, পালানোর আগেই ধরা প়ড়ে যায়।’’ তবে অরূপকে খুনের পরিকল্পনা ছিল না বলেই পরে পুলিশি তদন্তে উঠে আসে। এ দিকে পরেশের গ্রেফতারির পরে খুনে ব্যবহৃত দিশি পাইপগানটি তারাপীঠ পেরিয়ে কবিচন্দ্রপুর মোড় থেকে একটু দূরে আকন্দ গাছের ঝোপ থেকে উদ্ধার করে পুলিশ।

কিন্তু, কেন খুন?

ওই খুনের তদন্তে যুক্ত থাকা এক পুলিশ কর্তার দাবি, এলাকায় ঠিকাদারি ব্যবসা নিয়ে অরূপদের সঙ্গে বিবাদ ছিল পরিতোষের। ঘটনার বছর দু’য়ের আগে পরিতোষকে প্রাণে মারার চেষ্টাও হয়। তাতে অভিযুক্ত হিসেবে উঠে এসেছিল স্থানীয় ভাতজাংলা পঞ্চায়েতের সিপিএম সদস্য গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর ছেলে অরূপের নাম। তারই বদলায় ওই পরিকল্পনা বলে তদন্তে জানতে পারে পুলিশ।

এ দিকে, ওই খুনের ঘটনার পরে পুলিশ ৩০২ ধারায় রাজেশ, কোয়েল, পরিতোষ দত্তের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। রাজেশ প্রথম থেকেই জেল হেফাজতে। কোয়েলের বিচার চলছে জুভেনাইল আদালতে। বর্তমানে সে জামিনে মুক্ত। অন্য দিকে, রাজেশকে জিজ্ঞাসাবাদ করে খড়দহ এলাকার সুভাষ চক্রবর্তী, নিতাই দাসকে পুলিশ গ্রেফতার করে। খুনে যোগসাজসের অভিযোগ তুলে পুলিশ তাঁদের বিরুদ্ধে চার্জশিটও জমা দিয়েছে। তবে পরিতোষ এখনও পুলিশের খাতায় ফেরার। হারু দাস নামে এক অভিযুক্তের মৃত্যু হয়েছে। মামলাটি রামপুরহাট আদালতে বিচারাধীন। সরকারি আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, মামলাটি এখন ট্রায়াল পর্যায়ে আছে।

পাঁচ বছর আগের ঘটনা এখনও তাজা বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারে। রবিবার ফোনে ধরা গেল অরূপের বাবা গৌতমবাবুকে। তাঁর দাবি, ‘‘পরিতোষ একবার আক্রান্ত হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু তাতে আমাদের কোনও ভূমিকা ছিল না। ও পুরো ভুল বুঝে এমন মারাত্মক কাণ্ড করে বসল।’’ পরিবার সূত্রের খবর, মা অরুণাদেবীর মানসিক ছিল তারাপীঠে। সেই কারণেই সেখানে যান অরূপ। তার বছর দু’য়েক আগে বিয়ে হয়েছিল অরূপের।

miscreant
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy