এখানেই পড়েছিল গণেশের দেহ। (ডানদিকে) ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে রাখা হকিস্টিক। —নিজস্ব চিত্র
এলাকা দখল নিয়ে রেষারেষি ছিলই দু’টি সমাজবিরোধী গোষ্ঠীর মধ্যে। গণ্ডগোলও যে মাঝেমধ্যে বাধেনি, তা নয়। কিন্তু, তার জেরে রবিবার রাতে যে ঘটনা ঘটল গঙ্গাজলঘাটির মেজিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র (এমটিপিএস) সংলগ্ন লাগাপাড়ায়, তাতে ভয়ে কাঁটা হয়ে রয়েছেন এলাকার সাধারণ মানুষ। এক গোষ্ঠীর লোকজনের উপরে অতর্কিতে বোমা, গুলি নিয়ে হামলা চালানোর অভিযোগ উঠল অন্য গোষ্ঠী। ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে এক জনের। জখম আরও এক।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, নিহতের নাম গণেশ সূত্রধর (৩৫)। লাগাপাড়া সংলগ্ন পাকতোড় এলাকার বাসিন্দা গণেশের বিরুদ্ধে স্থানীয় থানায় এলাকার ঠিকাদারদের কাছে তোলা আদায়, এমটিপিএসে কর্মী নিয়োগকে কেন্দ্র করে সিন্ডিকেট চালানো-সহ একাধিক অভিযোগ রয়েছে। ঘটনায় রাজনৈতিক রংও লেগেছে। শালতোড়ার তৃণমূল বিধায়ক স্বপন বাউরি নিহতকে দলীয় কর্মী বলে দাবি করেছেন। স্বপনবাবু বলেন, “বিধানসভা নির্বাচনের সময় থেকে গণেশ দলের কর্মী হিসেবে এলাকায় কাজ করেছে।’’ স্বপনবাবুর এই মন্তব্যে বিতর্ক দানা বেঁধেছে দলের অন্দরেই। জেলা তৃণমূল নেতা তথা বাঁকুড়ার সভাধিপতি অরূপ চক্রবর্তীর দাবি, “মৃত ব্যক্তির সঙ্গে আমাদের দলের কোনও সম্পর্ক ছিল না। এলাকার দু’টি সমাজবিরোধী গোষ্ঠীর লড়াইয়ে এই ঘটনা ঘটেছে।’’ লাগাপাড়া অঞ্চল তৃণমূল সভাপতি নিমাই মাজিও বলেন, “গণেশ এলাকায় তোলাবাজি করত। শুনেছি, অন্য একটি তোলাবাজ গোষ্ঠীই তার ওপর এই হামলা চালিয়েছে।’’
নিহতের স্ত্রী হেনা সূত্রধর গঙ্গাজলঘাটি থানায় চার জনের নামে খুনের অভিযোগ দায়ের করেছেন। অভিযুক্তদের মধ্যে লাগাপাড়ার বাসিন্দা চন্দন গরাই, পাকতোড়ের বাপ্পা গরাই ও পথিক গরাইকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তবে মূল অভিযুক্ত, পাকতোড় এলাকার বাসিন্দা সমীরণ গরাই পলাতক। এফআইআরে নাম না থাকলেও সমীরণের বাবা স্বপন গরাইকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। সূত্রের খবর, স্বপনবাবুর বিরুদ্ধে এমটিপিএসে তোলাবাজির অভিযোগ উঠেছে। সোমবার ধৃতদের বাঁকুড়া আদালতে তোলা হলে প্রথম তিন জনের ছ’দিনের পুলিশ হেফাজতের নির্দেশ হয়। সমীরণের বাবার ১৪ দিন জেলা হেফজাত হয়েছে। বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার সুখেন্দু হীরা বলেন, “লাগাপাড়ার ঘটনায় মোট চার জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তদন্ত চলছে।’’
মেজিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে কর্মী নিয়োগকে ঘিরে সিন্ডিকেট চালানো এবং স্থানীয় ঠিকাদারদের কাছে তোলাবাজির অভিযোগ রয়েছে গণেশ ও সমীরণ। এই নিয়ে দুই শিবিরের মধ্যে ঝামেলাও ছিল। বিশেষ করে এলাকা দখলকে ঘিরে দীর্ঘদিন ধরেই ওই দুই গোষ্ঠীর লোকজনের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যাচ্ছে, ঘটনার রাতে মোটরবাইকে তাঁর সব সময়ের সঙ্গী পাকতোড়ের বাসিন্দা ঝন্টু গরাইকে নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন গণেশ। লাগাপাড়ার গলিতে ঢোকার পরেই সমীরণ ও তাঁর দলবলের সামনে পড়ে যান তাঁরা।
প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জেনেছে, গণেশের সঙ্গে কোনও বিষয় নিয়ে বচসা বাধে সমীরণের। অভিযোগ, এর পরেই হকি স্টিক দিয়ে গণেশ ও ঝন্টুকে বেধড়ক মারধর করে সমীরণ ও তাঁর দলবল। রক্তাক্ত অবস্থায় ঝন্টু কোনও মতে বাইক থেকে নেমে পালাতে পারলেও গণেশ পারেননি। গণেশকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় রাস্তার পাশের ফাঁকা জায়গায়। সেখানে একটি ডাম্পার দাঁড়িয়েছিল। ওই ডাম্পারের পাশে মাটিতে ফেলে তাঁকে ফের পেটানো হয় হকি স্টিক দিয়ে। লাগাপাড়ার বাসিন্দারা জানালেন, ওই দুই গোষ্ঠীর ঝামেলা প্রায়ই বাধে। কিন্তু, রবিবার রাতে যে মাত্রায় সংঘর্ষ হয়েছে তাতে, তাঁরা স্তম্ভিত। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েক জন জানান, বোমা ও গুলির শব্দে রাত দশটা নাগাদ এলাকা কেঁপে ওঠে। চিৎকারও শোনা যাচ্ছিল। খানিক পরে পরিস্থিতি শান্ত হতেই তাঁরা বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তায় রক্তের দাগ দেখতে পান। বোমার স্প্লিন্টারও রাস্তার ধারে পড়ে থাকতে দেখা যায়। স্থানীয় লোকজন ডাম্পারের পাশে রক্তাক্ত অবস্থায় কাতরাতে দেখেন গণেশকে।
এলাকার এক যুবকের কথায়, “ছটফট করতে করতে জল চাইছিল জখম ব্যক্তি। পুলিশ এসে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়।’’ নিহতের স্ত্রী-ও তাঁর অভিযোগে গণেশকে গুলি করে মারা হয়েছে বলেই লিখেছেন। পুলিশ সুপার অবশ্য বলেন, “ময়না তদন্তের রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে বলা মুশকিল।’’ ঘটনায় জখম ঝন্টুকে প্রথমে বাঁকুড়া মেডিক্যালে ভর্তি করানো হয়। চোট গুরুতর হওয়ায় তাঁকে বাইরের হাসপাতালে রেফার করা হয়েছে।
এ দিন ঘটনাস্থলে যেতেই এলাকাবাসীরা বেরিয়ে এসে পিচ রাস্তায় লেগে থাকা রক্তের দাগ দেখান। নিহত গণেশের জুতো জোড়া রাস্তার পাশেই পড়ে। রাস্তার পাশে একটি ঝোপের আড়ালে একাধিক হকিস্টিক লুকিয়ে রেখেছিল অততায়ীরা। এলাকার এক প্রবীণ বললেন, “এমটিপিএসে ছাই পুকুর, ঠিকা শ্রমিক নিয়োগ নিয়ে যে দুষ্কৃতী চক্র সক্রিয় রয়েছে, তার প্রমাণ সব সময়ই পাই আমরা। তবে পাড়ার রাস্তায় এ রকম খুনের ঘটনা আগে দেখিনি। এখন তো বাইরে বেরোতেই ভয় পাচ্ছি!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy