Advertisement
E-Paper

অত বলার পরেও কেন যে পালাল না!

বন্ধুকে সতর্ক করেছিলেন— ‘‘তুই যাস না। ওরা খুঁজে বেরাচ্ছে। পেলেই মেরে ফেলবে তোকে’’। কিন্তু বন্ধু কথা শোনেনি! ফোন কেটে দিয়েছিলেন। আর তার ঘণ্টাখানেক পরেই এক দলীয় কর্মী ফোন করে জানিয়েছিলেনস ‘‘সব শেষ হয়ে গিয়েছে।’’

স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০১৬ ০২:৩৩

বন্ধুকে সতর্ক করেছিলেন— ‘‘তুই যাস না। ওরা খুঁজে বেরাচ্ছে। পেলেই মেরে ফেলবে তোকে’’। কিন্তু বন্ধু কথা শোনেনি! ফোন কেটে দিয়েছিলেন। আর তার ঘণ্টাখানেক পরেই এক দলীয় কর্মী ফোন করে জানিয়েছিলেনস ‘‘সব শেষ হয়ে গিয়েছে।’’

প্রায় পাঁচ বছর আগে তাঁর বন্ধু সিপিএম কর্মী সীতারাম কুণ্ডুর খুনের ঘটনার কথা বলতে বলতে আবেগে গলা জড়িয়ে আসছিল সিপিএমের বিষ্ণুপুর উত্তর লোকাল কমিটির সম্পাদক নকুল দে-র।

কী হয়েছিল সে দিন?

দিনটা ছিল ২৫ জুন ২০১১ সাল। ‘বদলা নয় বদল চাই’ স্লোগান দিয়ে রাজ্যে সদ্য ক্ষমতায় এসেছে তৃণমূল। দীর্ঘদিন বিষ্ণুপুর বিধানসভা কেন্দ্র সিপিএমের থাকলেও সেখানেও তৃণমূল জিতেছিল। এই কেন্দ্রের রাধানগর, ডিহর, জন্তার মতো প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে তখন বাছাই করে করে সিপিএম কর্মীদের মারধর করা হচ্ছে। ভাঙচুর চালানো হচ্ছে সিপিএমের দলীয় কার্যালয়গুলিতেও। সব ক্ষেত্রেই অভিযোগের তির তৃণমূলের দিকে। সেই হামলার জেরেই কয়েক দিন আগে নিজের গ্রাম ছেড়ে খাতড়ায় আত্মগোপন করেছিলেন নকুলবাবু। ফোনে দলের কর্মীদের কাছ থেকে এলাকার খবর রাখছিলেন। ২৬ জুন সন্ধ্যা থেকেই রাধানগর ও সংলগ্ন গ্রামগুলিতে তাণ্ডব শুরু করে দুষ্কৃতীরা। রাধানগর ও জয়কৃষ্ণপুরের সিপিএমের শাখা অফিসেও ভাঙচুর চালানো হয়। জয়কৃষ্ণপুরের শাখা অফিসে বসে থাকা সিপিএম কর্মী কাজল বিশ্বাসকে বেধড়ক মারধর করার অভিযোগ ওঠে।

এরপরেই দুষ্কৃতীরা পা বাড়ায় সীতারামবাবুর গ্রাম জন্তার দিকে। সেই খবর পেয়েই সীতারামবাবুকে ফোন করেন নকুলবাবু। সীতারামবাবু সে দিন পারিবারিক কাজে বাঁকুড়া গিয়েছিলেন। সন্ধ্যায় মোটরবাইক নিয়ে গ্রামে ফিরছিলেন। নকুলবাবু বলেন, “ফোন করে কাজলের উপর হামলার ঘটনা ওকে জানাই। গ্রামেও যেতে নিষেধ করি।’’ নকুলবাবু জানাচ্ছেন, নিষেধ মানেননি সীতারামবাবু। বরং জখম কাজলের পরিবারের পাশে থাকতেই হবে জানিয়ে ফোন কেটে দেন তিনি।

জন্তায় ফিরেই বাড়িতে মোটরবাইক রেখে গ্রামের পার্টি অফিসে গিয়েছিলেন সীতারামবাবু। সেই সময় এক দল দুষ্কৃতী পার্টি অফিস ঘেরাও করছিল। পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে দেখে সীতারামবাবু পার্টি অফিস সংলগ্ন এক ব্যক্তির বাড়িতে ঢুকে যান। কিন্তু দুষ্কৃতীদের এড়াতে পারেননি।

সেই বাড়ি থেকে তাঁকে বের করে লাঠি, রড দিয়ে মারতে থাকেন দুষ্কৃতীরা। স্থানীয় লোকজন জানান, খুনের নৃশংসতা এতটাই ছিল যে শাবল দিয়ে সীতারামবাবুর মাথার দু’পাশ এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছিল ওরা! খুনের পর দুষ্কৃতীরা সীতারামবাবুর দেহ লোপাটের জন্য নদীতেই গর্ত খুঁড়ে পুঁতে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু দাদাকে খুঁজতে খুঁজতে সীতারামবাবুর ভাই রাধেশ্যাম কুণ্ডু নদীতে চলে আসেন। তাঁকে দেখেই দুষ্কৃতীরা দেহ ফেলে দিয়ে পালায়। তখনও কিন্তু দেহে প্রাণ ছিল সীতারামবাবুর। তাঁর স্ত্রী মিঠুদেবী জানান, তাঁকে খুন করা হয়েছে শুনেই নদীর দিকে ছুটে যায় গোটা পরিবার। তাঁর কথায়, “গিয়ে দেখি অত অত্যাচারের পর তখনও মানুষটা বেঁচে রয়েছে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়ি খোঁজাখুজি শুরু হল। কিন্তু তৃণমূল এ গ্রামের ও আশপাশের গ্রামের লোকজনকে গাড়ি বের করতে বারণ করে দেয়। চোখের সামনে দেখলাম ধীরে ধীরে মানুষটার দেহ স্তব্ধ হয়ে গেল।”

সীতারামবাবুর ছোট মেয়ে সুনীতার বয়স তখন বছর বারো। ওই ঘটনাটা তাঁর কচি মনে ঝাঁকুনি দিয়ে গিয়েছিল। সে দিনের কথা এখনও যেন তার চোখের সামনে ভাসে। সে বলে, “আমি নাচের স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেছি। বাবা আমার হাতে পাঁচ টাকা দিয়ে বলেছিল বাঁকুড়া যাচ্ছে। তারপর বাবাকে যখন দেখলাম তখন তাঁর গোটা শরীর ক্ষতবিক্ষত। রক্ত ঝরছে। মাটিতে শুয়ে কাতরাচ্ছে। আমি ভয়ে দু’চোখ বন্ধ করে নিয়েছিলাম।”

সীতারামবাবুর খুনের ঘটনা বিষ্ণুপুর থানায় ১০৩/১১ কেস নম্বরেই বন্দি। ঘটনার পরেই সীতারামবাবুর পরিবারের তরফে ন’জন ব্যক্তির বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ দায়ের করা হয়। এলাকায় খবর নিয়ে জানা যায়, অভিযুক্তেরা সকলেই তৃণমূল কর্মী বলে পরিচিত। পুলিশ ঘটনার পরেই আটজনকে গ্রেফতার করে। আর এক অভিযুক্ত পরে আত্মসমর্পণ করে। বর্তমানে সবাই জামিনে মুক্ত। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ঘটনার চার্জশিট জমা দেয় পুলিশ। কিন্তু এর বেশি আর মামলার অগ্রগতি নেই। বিষ্ণুপুর আদালতের সরকারি আইনজীবীদের একটা বড় অংশই মামলাটির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বলতে পারছেন না। এক আইনজীবী বলেন, “মামলাটি এখনও পুলিশ কোর্টেই আটকে রয়েছে। ট্রায়ালও শুরু হয়নি।”

কেন হয়নি? তার জবাব মেলেনি প্রশাসনিক মহলের কোনও স্তর থেকেও। নকুলবাবু বলছেন, “হবে কী করে? সরকারটা কাদের দেখতে হবে তো! শাসক দলের চাপেই এতবড় হত্যাকাণ্ড চাপা পড়ে গিয়েছে।” তৃণমূল অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। মিঠুদেবী বলছেন, “শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণেই আমার স্বামীকে খুন করল ওরা। কিন্তু বিচার কি মিলবে?’’

Fled CPM Sitaram Kundu
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy