Advertisement
E-Paper

লোহার বেড়ি পায়ে কেটেছে দশ বছর

হাত পাঁচেক লম্বা শিকল। এক প্রান্ত আটকানো লোহার খুঁটিতে। অন্য প্রান্তে বাঁধা বছর চল্লিশের যুবক। লোহার বেড়ি পায়ে দশ বছর কাটিয়ে দিয়েছেন বান্দোয়ানের গোবর্ধন মাহাতো। 

সমীর দত্ত ও রথীন্দ্রনাথ মাহাতো

শেষ আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০১৯ ০৪:০৪
ঘরবন্দি। নিজস্ব চিত্র

ঘরবন্দি। নিজস্ব চিত্র

হাত পাঁচেক লম্বা শিকল। এক প্রান্ত আটকানো লোহার খুঁটিতে। অন্য প্রান্তে বাঁধা বছর চল্লিশের যুবক। লোহার বেড়ি পায়ে দশ বছর কাটিয়ে দিয়েছেন বান্দোয়ানের গোবর্ধন মাহাতো।

১৫ বছর ধরে মানসিক রোগে আক্রান্ত পুরুলিয়ার রোলাডি গ্রামের গোবর্ধন। দরিদ্র পরিবার তাঁর পর্যাপ্ত চিকিৎসার বন্দোবস্ত করতে পারেনি। ফলে, রোগ ক্রমশ জটিল হয়। প্রতিবেশীদের আঁচড়ে-কামড়ে দিয়েছিলেন কয়েকবার। গলা টিপে ধরেছিলেন কয়েকজনের। রাস্তায় একটি সব্জির গাড়িও ভাঙচুর করেন। আর ঝুঁকি নেয়নি তাঁর পরিবার। বাড়ির অদূরে একটি ঘরে শিকলে বেঁধে রাখা হয় গোবর্ধনকে।

মেরেকেটে ৮০ বর্গফুটের একটি ইটের ঘর। মাথায় অ্যাসবেস্টসের ছাউনি। ঘরের দু’দিকে দরজার জায়গা থাকলেও দরজা নেই। এক কোণে কংক্রিটের মেঝেতে পোঁতা লোহার খুঁটিতেই বাঁধা গোবর্ধন। দু’পায়েই বেড়ি। কোমরে জড়ানো এক খণ্ড কাপড়ে লজ্জা ঢেকেছেন। ঘরের ইতিউতি ছড়ানো খড়ের আঁটি। তা থেকে একটা একটা করে খড় বার করে দড়ি তৈরি করেন গৌবর্ধন। সেটাই তাঁর সারা দিনের কাজ।

কেমন আছেন?

মুখ তুললেন গোবর্ধন। পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘‘কে আপনি?’’ তারপরে সামনে রাখা খড়ের আঁটি থেকে খড় বার করলেন। মেতে গেলেন দড়ি তৈরির কাজে।

পরিবারের লোকজন দু’বেলা খাবার দিয়ে যান গোবর্ধনকে। শৌচের দরকার পড়লে চিৎকার করে মা-ভাইদের ডাকেন তিনি। তাঁরাই খুঁটি থেকে শিকল খুলে বাইরে নিয়ে যান গোবর্ধনকে। কিছুক্ষণ বাইরে কাটিয়ে ফের ঘরে। গোবর্ধনের মা পারুল বলেন, ‘‘বছর কুড়ি আগে ছেলের বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু মাস ছয়েকও টেকেনি বিয়ে। ভাল হারমোনিয়াম বাজাতে পারত গোবর্ধন। ঝুমুর গানের গলাও ছিল বেশ ভাল।’’

দাদা শলাবত জানান, গোবর্ধন ইটভাটায় কাজ করতেন। ঝুমুর-বাউল গান গাইতেন। বাদ্যযন্ত্র-ও বাজাতেন। প্রায় দেড় দশক আগে থেকে মানসিক রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। শলাবতের কথায়, ‘‘প্রথম দিকে তেমন আমল দিইনি। পরে বাড়াবাড়ি হতে চিকিৎসা করিয়েছি। কিন্তু তা অনিয়মিত। তাই কাজ কিছু হয়নি।’’

ছোট ভাই শঙ্কর বলেন, ‘‘বাইরে নিয়ে গিয়ে দাদার চিকিৎসা চালাব, এত টাকা নেই। চিকিৎসা চালাতে গিয়ে ঘরের জিনিস বিক্রি করতে হয়েছে। ওর চিকিৎসার জন্য অনেকের কাছে আর্জি জানিয়েছিলাম।’’

গোবর্ধনের এক সময়ের বন্ধু পুঞ্চার বনগ্রামের বাসিন্দা গুরুপদ লায়েক বলেন, ‘‘গোবর্ধন সবার সঙ্গে হেসে কথা বলত। ওর যে এমন হবে, কল্পনাও করতে পারিনি।’’

২০০১ সালের ৬ অগস্ট তামিলনাড়ুর এরওয়াড়ি গ্রামে পুড়ে মারা যান ২৮ জন মানসিক রোগী। প্রত্যেকের পায়ের শিকল খুঁটির সঙ্গে বাঁধা ছিল। সুপ্রিম কোর্ট স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সেই বিষয়টি বিচারের জন্য গ্রহণ করে। চিকিৎসাধীন মানসিক রোগীদের কোনও ভাবে বেঁধে রাখা যাবে না বলে রায় দেওয়া হয়। শলাবত অবশ্য বলেন, ‘‘জানি, কাউকে শেকলে বেঁধে রাখা অপরাধ। কিন্তু ওর জন্যে গ্রামের সকলের সঙ্গে ঝগড়া হচ্ছিল। বাধ্য হয়েই বেঁধে রেখেছি।’’

বান্দোয়ানের বিডিও শুভঙ্কর দাস বলেন, ‘‘খবর পেয়েছি রোলাডি গ্রামে এক জনকে শেকলে বেঁধে রাখা হয়েছে। ওঁর মানসিক রোগের চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন স্তরে যোগাযোগ করা হচ্ছে।’’

Mentally Disturbed Bandwan
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy