Advertisement
১৯ মে ২০২৪

বাতিল নোট ঝাঁপ ফেলছে বিড়ি কারখানার

পাঁচশো-হাজারের নোট অচলের ধাক্কায় রাতারাতি সঙ্কট নেমে এসেছে পুরুলিয়া জেলার বিড়ি শিল্পে। ১০০ টাকার নোটের অভাবে ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গিয়েছে জেলার একের পর এক বিড়ি কারখানার। রাতারাতি রুজিহীন হাজার হাজার শ্রমিক।

জমে রয়েছে তৈরি হওয়া বিড়ি। (ডান দিকে) ঝালদার একটি কারখানায় কাজ চলছে কয়েক জন শ্রমিককে দিয়েই। —প্রদীপ মাহাতো।

জমে রয়েছে তৈরি হওয়া বিড়ি। (ডান দিকে) ঝালদার একটি কারখানায় কাজ চলছে কয়েক জন শ্রমিককে দিয়েই। —প্রদীপ মাহাতো।

প্রশান্ত পাল
পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০১৬ ০০:৪৭
Share: Save:

পাঁচশো-হাজারের নোট অচলের ধাক্কায় রাতারাতি সঙ্কট নেমে এসেছে পুরুলিয়া জেলার বিড়ি শিল্পে। ১০০ টাকার নোটের অভাবে ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গিয়েছে জেলার একের পর এক বিড়ি কারখানার। রাতারাতি রুজিহীন হাজার হাজার শ্রমিক। কী করবেন, কী ভাবে সংসার চলবে ভেবে কুল কিনারা পাচ্ছেন না শ্রমিকেরা। কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে আপাতত সেদিকে চেয়ে থাকা ছাড়া আর অন্য পথ যে নেই শ্রমিকদের, আাপতত সে কথাই বলছে মালিকপক্ষ।

এ রাজ্যের মুর্শিদাবাদে বিড়ি শিল্প সবচেয়ে বেশি রয়েছে। পুরুলিয়ায় তুলনায় বিড়ি কারখানা কম হলেও তা খুব কম নয়। রাঢ়বঙ্গের এই জেলায় বড় শিল্প সে অর্থে নেই। কুটির শিল্প বলতে বিড়ি শিল্পেরই প্রসার বেশি। দীর্ঘদিন ধরেই এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত হাজার হাজার মানুষ। জেলার বিড়ি শ্রমিকদের সংগঠনগুলির যৌথ সংগ্রাম কমিটির মুখপাত্র ভীম কুমার জানালেন, পুরুলিয়ায় লক্ষাধিক বিড়ি শ্রমিক আছেন। ঝালদা ১ ও ২, জয়পুর, আড়শা, পাড়া ব্লকে বিড়ি কারখানা বেশি। তবে কাশীপুর, রঘুনাথপুর ১-সহ আরও কিছু ব্লকে শ্রমিকেরা রয়েছেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের পাঁচশো ও হাজার টাকার নোট বাতিলের সিদ্ধান্তে রাতারাতি এই শিল্পে সঙ্কট নেমে এসেছে। কারণ, এই শিল্পে শ্রমিকদের মজুরি দেওয়ার চল আজও নগদ টাকাতেই। গোটা সপ্তাহ ধরে বিড়ি তৈরি করার পরে শ্রমিকদের সপ্তাহে মজুরি দেওয়া হয়। নোট বাতিল এবং ব্যাঙ্ক থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা তোলা যাবে, এই নির্দেশের পরে শ্রমিকদের হাতে মজুরি নেই। সমস্ত কারখানারই ঝাঁপ বন্ধ।

ওই শ্রমিক সংগঠন সূত্রে জানা যাচ্ছে, জেলায় বড় বিড়ি কারখানার সংখ্যা গোটা কুড়ি। মাঝারি কারখানা রয়েছে প্রায় ৪০টি। এ ছাড়াও আছে শ’খানেক ছোট কারখানা। ভীমবাবু বলেন, ‘‘এগুলিকে ফুটপাথের কারখানা বলা চলে। খুবই কম শ্রমিক, কম মূলধন। উৎপাদনও কম। কখনও চলে, কখনও বন্ধ হয়। তবে এই ধরনের ছোট কারখানাগুলির সঙ্গে বহু শ্রমিক জড়িত। নোট বাতিল হওয়ার জেরে কারখানা বন্ধ। মজুরি না পেয়ে শ্রমিকদের খুবই কষ্টে দিন কাটছে।’’

বড় বড় বিড়ির কারখানাগুলির সরাসরি নিজস্ব শ্রমিক নেই। মালিকপক্ষ কমিশন এজেন্টদের বিড়ি তৈরির কাঁচামাল দিয়ে দেন। শ্রমিকেরা এই এজেন্টদের কাছ থেকে কাঁচামাল নিয়ে বিড়ি তৈরি করে পুনরায় এজেন্টদের কাছে দিলে তাঁরা বিড়ি কারখানায় জমা করে দেন। সপ্তাহ শেষে হিসেব করে শ্রমিকদের হাতে মজুরি তুলে দেওয়া হয়। গত ৮ নভেম্বর রাতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ৫০০-১০০০ টাকার নোট বাতিল ঘোষণার পরেই মজুরি পেতে সমস্যায় পড়তে হয়েছে শ্রমিকদের।

ঝালদার একটি বিড়ি কারখানার কর্তা রাইমোহন সাহা জানালেন, তাঁদের কারখানায় শ্রমিকদের মজুরি দেওয়া হয় প্রতি মাসের ৯ তারিখে। মাসের প্রথম সপ্তাহ শেষের পরে ৮ তারিখ মজুরি হিসেব করা হয়। তার পরের দিন মজুরি মেটানো হয়।

তাঁর কথায়, ‘‘এ মাসেও শ্রমিকদের মজুরি দেওয়ার জন্য ৮ তারিখে ৮ লক্ষ টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তুলেছিলাম। বেশির ভাগই পাঁচশো-হাজারের নোট। কিন্তু ওই রাতেই এই দু’টি নোট অচল হয়ে গেল! টাকা ব্যাঙ্কে ফের জমা করলাম বটে। কিন্তু আমাদের কারখানা চালানোর জন্য যে পরিমাণ টাকা তোলার প্রয়োজন, তার সিকিভাগও এখন ব্যাঙ্ক থেকে তোলা যাচ্ছে না।’’ রাইমোহনবাবু জানান, কারখানা চালাতে সপ্তাহে ১৫-২০ লক্ষ টাকা প্রয়োজন। অথচ সেই টাকা তোলার কোনও উপায় নেই। টাকার অভাবে কারখানাই বন্ধ করে দিতে হয়েছে।

শ্রমিকদের অবশ্য অভিযোগ, তাঁরা কাজ করেও মজুরি পাচ্ছেন না। রাইমোহনবাবুর জবাব, নোট বাতিলের জন্যই যে বাধ্য হয়ে কারখানা বন্ধ করতে হচ্ছে, তা নোটিস দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। অবস্থা স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত উৎপাদন কোনও ভাবেই সম্ভব নয়। তাঁর দাবি, শ্রমিকদের মজুরির বিষয়টি মাথায় রেখে তাঁরা ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করেছিলেন টাকা দেওয়ার জন্য। কিন্তু সেই আবেদনে সাড়া মেলেনি। একই অভিজ্ঞতা ঝালদার আর একটি বিড়ি কারখানার মালিক কালীপদ চট্টোপাধ্যায়ের। তিনি বলেন, ‘‘আমাদেরও কারখানা চালাতে সপ্তাহে ১৫-২০ লক্ষ টাকা প্রয়োজন। কিন্তু এই অচলাবস্থার জেরে কারখানা বন্ধ করে দিতে হয়েছে।’’

ঝালদার কয়েকটি কারখানায় গিয়ে দেখা গিয়েছে সব সুনসান। অন্য দিনগুলিতে যে-সব কারখানায় প্রচণ্ড ব্যস্ততা চোখে পড়ে, এখন তা উধাও। কোথাও কর্মীরা ইতস্তত ছড়িয়ে বসে রয়েছেন। যেখানে বিড়ি প্যাকিংয়ের কাজ হয় সেখানেও গুটিকয় কর্মী কাজ করছেন। শ্রীপতি মাহাতো নামে এক কর্মীর কথায়, ‘‘কাজ হচ্ছে না। মজুরিও মিলছে না। শ্রমিক এসে করবে কী? তাই সব ফাঁকা।’’ ঝালদা ২ ব্লকের মাতকুমা গ্রামের বাসিন্দা বিড়ি শ্রমিক শিবনাথ কুমার, আদারডি গ্রামের মথন কুমার, খেদাডি গ্রামের সমীর কুমারের হতাশা, ‘‘হাতে কাজ নেই। তাই মজুরিও নেই। সব কারখানা বন্ধ। কী ভাবে সংসার চলবে বুঝতে পারছি না।’’

ঝালদার বাসিন্দা, পেশায় বিড়ি শ্রমিক সুবল রজক, নিয়তি রজকরা বলেন, ‘‘সপ্তাহের মজুরিটুকু দিয়েই তো আমাদের সংসার চলে। ধার করে খুব কষ্টে সংসার টানছি। এর পরে কী হবে, কিছুই জানি না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Demonetisation Bidi factory
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE