Advertisement
১৭ জুন ২০২৪
নেতাদেরই দুষছেন পুরুলিয়ার নিচুতলার বিজেপি কর্মীরা

আন্দোলনের খামতিই আনল বিপর্যয়

হাঁকডাকই সার। প্রচার ও আন্দোলনের খামতিতেই পুরুলিয়ায় ভরাডুবি বিজেপির। পুরভোটের ফল ঘোষণার পরে ময়নাতদন্তে নেমে দলের নিচুতলা থেকে জেলা নেতৃত্বের একাংশ এমনই মনে করছেন। নির্বাচনের আগে নেতারা জোর গলাতেই দাবি করছিলেন পুরুলিয়ার তিনটি পুরসভার মধ্যে একটিতে বোর্ড গড়ছেন তাঁরা। বাকি দুই পুরসভাতেও দল অপ্রত্যাশিত ফল করবে।

শুভ্রপ্রকাশ মণ্ডল
পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০১৫ ০৩:০৯
Share: Save:

হাঁকডাকই সার। প্রচার ও আন্দোলনের খামতিতেই পুরুলিয়ায় ভরাডুবি বিজেপির। পুরভোটের ফল ঘোষণার পরে ময়নাতদন্তে নেমে দলের নিচুতলা থেকে জেলা নেতৃত্বের একাংশ এমনই মনে করছেন।

নির্বাচনের আগে নেতারা জোর গলাতেই দাবি করছিলেন পুরুলিয়ার তিনটি পুরসভার মধ্যে একটিতে বোর্ড গড়ছেন তাঁরা। বাকি দুই পুরসভাতেও দল অপ্রত্যাশিত ফল করবে। কিন্তু ফল প্রকাশের পরে দেখা যাচ্ছে, বোর্ড গঠন দূর অস্ত্, জেলার তিন পুরসভার ৪৮টি আসনের মধ্যে শুধু রঘুনাথপুরেই একটি আসন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হল বিজেপিকে। রঘুনাথপুরে লোকসভায় প্রাপ্ত ভোট ধরে রাখতেও অসমর্থ হল গেরুয়া শিবির। বরং ৫ শতাংশের বেশি ভোট কমল এই শহরে। সব মিলিয়ে তিন পুরসভায় বিরোধী হিসাবে বিজেপি উঠে আসতে পারল না।

লোকসভা ভোটের পরে পুরুলিয়ায় উত্থান ঘটেছিল বিজেপির। লোকসভা ভোটের ফলের নিরিখে রঘুনাথপুর পুরএলাকায় পাঁচটি ওয়ার্ডে বিজেপি এগিয়ে ছিল। জানুয়ারি মাসে পুরুলিয়া জেলার তিনটি কলেজের ছাত্র সংসদের নির্বাচনেও অভাবনীয় সাফল্যর পায় আরএসএস প্রভাবিত ছাত্র সংগঠন এবিভিপি। সেই প্রেক্ষিতেই জেলার রাজনতিক মহলের একাংশ আশা করছিল, পুরনির্বাচনে সাফল্য পাবে গেরুয়া শিবির। দলের কর্মী সমর্থকদের মধ্যেও সেই আশা তৈরি হয়েছিল।

কিন্তু পুরভোটের নির্বাচনের পরে দেখা যাচ্ছে, তিনটি পুরসভার মধ্যে একটিতেও বিরোধী হিসাবেও উঠে আসতে পারেনি বিজেপি। পুরনির্বাচনের ফলে চোখ রাখলেই দেখা যায়, পুরুলিয়ায় ২৩টি ওয়ার্ডের মধ্যে মাত্র ৭টিতে দ্বিতীয় স্থান পেয়েছে তারা। ঝালদায় প্রথমে ১২টি আসনে প্রার্থী দিলেও পরে দু’টি আসনে বিজেপির প্রার্থীরা মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেন। এখানে ১০টি আসনের মধ্যে মাত্র দু’টিতে দ্বিতীয় স্থান পায় বিজেপি। ঝালদার অচ্ছ্রুরাম মোমোরিয়াল কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেলেও পুরনির্বাচনে শোচনীয় অবস্থায় হয়েছে বিজেপির। দশটির মধ্যে মাত্র চারটি ওয়ার্ডে তিন অঙ্কের ভোট পেয়েছেন প্রার্থীরা। রঘুনাথপুরের ১৩টি আসনের মধ্যে একটিতে জেতে। এ ছাড়া বাকি চারটি ওয়ার্ডে দ্বিতীয়স্থান ধরে রাখতে পারে গেরুয়া শিবির। অথচ এই শহরই দখল করার দাবি তুলেছিল তারা।

নির্বাচনে বিজেপির এই হাঁড়ির হাল কেন হল তা নিয়েই এ বার প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে দলের অন্দরেই। কারণ হিসাবে দলীয় ভাবে প্রাথমিক তদন্তে উঠে আসছে পুরসভাগুলিতে দলের নেতাদের আন্দোলন বিমুখতার বিষয়টি। দলের নিচুতলার কর্মীদেরও অভিযোগ, ‘‘গত পাঁচ বছরে পুরপরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে শাসকদলের ব্যর্থতা নিয়ে সে ভাবে প্রচারে জোর দেওয়া যায়নি। তা ছাড়া, দুর্নীতির মতো ব্যাপারেও দল আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি।’’ তাঁদের দাবি, মানুষের মন বুঝতে ব্যর্থ এই নেতাদের একাংশ বরং বেশি ব্যস্ত ছিলেন নিজেদের পছন্দসই লোকদের জন্য নির্বাচনে টিকিট আদায়ের কাজে।

নির্বাচনে টিকিট বিলি নিয়ে দলের অভ্যন্তরের কোন্দলও বিজেপির এই বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন দলের একাংশ। রঘুনাথপুরের কিছু প্রার্থী ও গুরুত্বপূর্ণ কর্মীদের কথায়, ‘‘লোকসভায় ফলের নিরিখে পাঁচটি ওয়ার্ডে দল এগিয়ে থাকায় ওয়ার্ড কমিটিগুলির নেতারা ভেবেই নিয়েছিলেন পুরসভা দখল হচ্ছে। তাই নির্বাচনে টিকিট পেতে তাঁরা মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। টিকিট না পেয়ে তাদের মধ্যে অনেকেই বিক্ষুব্ধ হয়ে বসে পড়েন বা তলে তলে বিপক্ষ দলকে সমর্থন জুগিয়েছেন।’’ নির্বাচনে টিকিট নিয়ে দলের অভ্যন্তরের এই কোন্দল যে তাদের পক্ষে বড় সমস্যা হয়ে উঠেছিল, তা এখন মানছেন দলের জেলা সভাপতি বিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়ও।

এরসঙ্গে যোগ হয়েছে তিন পুরসভাতেই পুরপরিষেবা নিয়ে আন্দোলন গড়ে ভোটারদের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের ক্ষেত্রে বিজেপির ব্যর্থতাও। জেলার রাজনীতি নিয়ে সচেতন মানুষজনের এই মতের সঙ্গে সহমত পোষণ করছেন বিজেপির কর্মীরাও। তাঁদের মতে, লোকসভা ভোটের পরে দলের স্বপক্ষে যে জনসমর্থন তৈরি হয়েছিল তাকে কাজে লাগিয়ে আন্দোলন তৈরির কাজই হয়নি। ঝালদা, পুরুলিয়া, রঘুনাথপুর তিন পুরশহরেই জল, নিকাশি, আবর্জনা সাফাই-সহ পুরপরিষেবা নিয়ে বাসিন্দাদের বিস্তর ক্ষোভ রয়েছে। এ ছাড়াও পুরসভাগুলিতে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে নানা কাজ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। কিন্তু সে সব নিয়ে আন্দোলনে নামতেই পারেননি বিজেপির নেতারা। সংগঠিত ভাবে পুর কতৃর্পক্ষগুলির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা যায়নি। তাই মানুষের কাছে বিজেপি বিকল্প দল হয়ে উঠতে পারেনি। উল্টে পুরভোটের মুখে গরম গরম বক্তৃতাই দিয়ে গিয়েছেন নেতারা। কিন্তু মানুষের সমস্যা নিয়ে মাঠে নেমে আন্দোলনে তাঁরা নামলে বেশি কাজ দিত। তা ছাড়া শাসকদলের নেতারা যেখানে মাটি কামড়ে ভোট করিয়েছেন, সেখানে বিজেপির নেতাদের ভূমিকা কী ছিল?

বিজেপি জেলা সভাপতির ব্যাখ্যা, ‘‘এই ফলের পিছনে অনেকগুলি কারণই রয়েছে। আন্দোলনে যেমন খামতি রয়েছে তেমনই স্থানীয় সমস্যা নিয়ে মানুষের পাশে সে ভাবেও দাঁড়ানো যায়নি। তবে এই সমস্যাগুলি কাটিয়ে আগামী দিনের জন্য নতুন ভাবে আমরা তৈরি হচ্ছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE