Advertisement
১১ মে ২০২৪

বিপজ্জনক দেওয়াল নিল শিশুর প্রাণ

ছুটির পরে মিড-ডে মিলের থালা হাতে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফিরছিল দুই ভাই। ভেবেছিল বাড়ি গিয়ে খাবে। খাওয়া আর হল না। পথেই হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল লাগোয়া হাইস্কুলের দেওয়াল। প্রাণ কাড়ল চার বছরের এক শিশুর। জখম ভাই-সহ তিন সহপাঠী। সোমবার সকালে নলহাটি থানার কয়থা গ্রামের ওই মর্মান্তিক ঘটনায় গাফিলতির অভিযোগ উঠেছে ওই স্কুলের কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।

ভেঙে পড়া দেওয়াল। সোমবার ঘটনার পরে নলহাটির কয়থা গ্রামে ছবিটি তুলেছেন সব্যসাচী ইসলাম।

ভেঙে পড়া দেওয়াল। সোমবার ঘটনার পরে নলহাটির কয়থা গ্রামে ছবিটি তুলেছেন সব্যসাচী ইসলাম।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নলহাটি শেষ আপডেট: ১৬ জুন ২০১৫ ০১:১০
Share: Save:

ছুটির পরে মিড-ডে মিলের থালা হাতে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফিরছিল দুই ভাই। ভেবেছিল বাড়ি গিয়ে খাবে। খাওয়া আর হল না। পথেই হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল লাগোয়া হাইস্কুলের দেওয়াল। প্রাণ কাড়ল চার বছরের এক শিশুর। জখম ভাই-সহ তিন সহপাঠী।

সোমবার সকালে নলহাটি থানার কয়থা গ্রামের ওই মর্মান্তিক ঘটনায় গাফিলতির অভিযোগ উঠেছে ওই স্কুলের কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। পুলিশ জানিয়েছে, মৃত শিশুর নাম নাজিরুল ইসলাম (৪)। ঘটনায় জখম শিশুদের মধ্যে একটিকে প্রাথমিক চিকিৎসার পরে ছেড়ে দেওয়া হলেও বাকি দু’জন রামপুরহাট মহকুমা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। প্রত্যেকেই সুসংহত শিশু বিকাশ প্রকল্পে নলহাটি ১ ব্লকের অধীন ১৫৫ নম্বর অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের পড়ুয়া। বাড়ি ওই গ্রামেই। ঘটনার খবর পেয়েই এলাকায় যান নলহাটি ১ বিডিও তাপস বিশ্বাস, আইসিডিএস প্রকল্পের সিডিপিও সামশুল হুদা।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, কয়থা এসএসআই হাইমাদ্রাসার জমিতে ওই অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রটির নিজস্ব ভবন রয়েছে। অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে যাতায়াতের পথেই হাইমাদ্রাসার ওই দেওয়ালটি পড়ে। প্রায় দশ বছরের পুরনো মাটি দিয়ে গাঁথা ওই ইটের দেওয়ালটির অবস্থা বর্তমানে ভঙ্গুর ছিল বলে এলাকাবাসীর দাবি। এ দিন প্রায় ১০ ফুট উঁচু ওই দেওয়ালেরই প্রায় ১৫ মিটার অংশ ভেঙে পড়ায় দুর্ঘটনাটি ঘটে। ওই ঘটনায় বাঁ পায়ে চোট পেয়েছে মৃত নাজিরুলের দাদা ছয় বছরের বালক রিয়াজুল। তার কথায়, ‘‘আমার একটু আগেই ভাই যাচ্ছিল। দু’জনের হাতেই মিলের থালা ছিল। হঠাৎ কে যেন ‘দেওয়াল পড়ছে, সরে যা’ বলে চিৎকার করে ওঠে। আমরা কিছু বুঝে উঠতেই হুড়মুড় শব্দ। দেওয়ালের ইট আমার পায়ে পড়ল। ভাইয়ের যে কী হল, তখন বুঝতে পারিনি। পরে লোক জন ছুটোছুটি ভাইকে যখন উদ্ধার করে, তত ক্ষণে ও মারা গিয়েছে।’’

ঘটনার পরেই স্কুল ছুটি দিয়ে দেন হাইমাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ। ওই স্কুলে বর্তমানে হস্টেল নির্মাণের কাজ চলছে। বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, ওই নির্মাণের জন্য জেসিবি দিয়ে গর্ত করা যাবতীয় মাটি এবং গর্ত বোজানোর বালি স্কুলের ওই দেওয়ালটির গায়েই রাখা ছিল। তার চাপেই দেওয়াল ভেঙে পড়েছে। এ দিন ঘটনার পরে এলাকায় গিয়েও দেখা যায় ভেঙে পড়া দেওয়ালের গায়ে থাকা বালি ও মাটির বেশ কিছুটা রাস্তায় চলে এসেছে। তাঁর কিছু দূরে দাঁড়িয়েই অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের কর্মী রাবেয়া খাতুন বলেন, ‘‘কপাল ভাল। অনেক শিশুই খাবার নিয়ে বাড়ি চলে গিয়েছিল। তা না হলে বড় ঘটনা ঘটতে পারত।’’

এ নিয়ে আবার স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং ঠিকাদার পরস্পরের প্রতি দোষারোপ শুরু করেছেন। হাইমাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আব্দুল রউবের দাবি, ‘‘স্কুল ছুটি ছিল। হস্টেল তৈরির জন্য গর্ত করা মাটি স্কুলের বাইরে থাকা একটি খালে ফেলে তা বুজিয়ে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, আজ স্কুলে পৌঁছে দেখতে পাই, স্কুলের ভিতরেই প্রায় ২০ ফুট উচ্চতায় মাটি রাখা হয়েছে।’’ তাঁর আরও দাবি, ভঙ্গুর দেওয়ালটি সংস্কারের জন্য গত মার্চেই তিনি বিডিও-র কাছে আবেদনপত্র জমা দিয়েছিলেন। দেওয়াল সংস্কারের আগেই এ দিনের অগঠন। অন্য দিকে, দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদার জহিরুল রহমানের দাবি, স্কুলের প্রধান শিক্ষকের নির্দেশেই মাটি স্কুলের ভিতর রাখা হয়েছিল। মজুত বালিও দেওয়াল থেকে ২ ফুট দূরে রাখা হয়েছিল বলে তাঁর দাবি।

পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, গ্রামের প্রাথমিক স্কুল বাড়ি থেকে দূরে বলে পেশায় ট্রাক্টর চালক জাকেরিয়া শেখ তাঁর তিন ছেলেকে বাড়ির কাছে ওই অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে ভর্তি করেছিলেন। দুই ভাই স্কুলে গেলেও এ দিন বাড়িতেই ছিল তাঁদের আর এক সন্তান। নাজিরুল দেওয়াল চাপা পড়ে মারা গিয়েছে, খবরটা শুনে প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারেননি মা রিজিনা বিবি। দৌড়ে গিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখেন, সকলে ছেলেকে বাড়ির দিকে নিয়ে আসছে। তত ক্ষণে সব শেষ। খবর পেয়ে গ্রামে গিয়েছিলেন বিডিও। তিনি বলেন, ‘‘মর্মান্তিক ঘটনা। তবে, এটা দুর্ঘটনা ছাড়া কিছু নয়। এসডিও-র সঙ্গে কথা হয়েছে। দেখা যাক কী হয়।’’

স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কি কোনও আইনি পদক্ষেপ করা হবে? সিডিপিও-র জবাব, ‘‘অঙ্গনওয়াড়ি ভবন নির্মাণের জন্য জায়গা পাওয়া যায় না। ওই স্কুল কর্তৃপক্ষ নিজেরাই ভবন নির্মাণের জন্য জায়গা দিয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে গেলে অনেক কিছু ব্যাপার জড়িয়ে আছে।’’ তবে, বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। তাদের নির্দেশ মতোই কাজ করা হবে বলে তিনি জানিয়েছেন। অন্য দিকে, এলাকার তৃণমূল নেতা তথা দলের কয়থা ১ অঞ্চল সভাপতি শাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘‘দেখা যাক প্রশাসন থেকে কী করে। তা না হলে আইনি ব্যবস্থার ব্যাপারে পরিবার যা চাইবে, তা-ই হবে।’’ তবে, পুলিশের কাছে এখনও কোনও অভিযোগ জমা পড়েনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE