Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

হোমের রেলিংয়ে বাঁধা শৈশব

রেলিংয়ে বাঁধা আড়াআড়ি কচি হাতদুটো! বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গরম হচ্ছে জানলার কাচ-রেলিং। কিন্তু নড়চড় তার করার উপায় নেই! করলেই যে হাতের বাঁধন চেপে বসছে কচি হাতে! সে তো কাঁদতেও পারে না চিৎকার করে। জন্মের মতো সে যে মূক! চোখে দেখতে পায় না।

নিজস্ব সংবাদদাতা
সিউড়ি শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০১৬ ০২:৪৬
Share: Save:

রেলিংয়ে বাঁধা আড়াআড়ি কচি হাতদুটো!

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গরম হচ্ছে জানলার কাচ-রেলিং। কিন্তু নড়চড় তার করার উপায় নেই!

করলেই যে হাতের বাঁধন চেপে বসছে কচি হাতে! সে তো কাঁদতেও পারে না চিৎকার করে। জন্মের মতো সে যে মূক! চোখে দেখতে পায় না। কানেও শুনতে পায় না। হাত-পায়ের আন্দাজে এতক্ষণে অবশ্য সে বুঝে গিয়েছে সিঁড়ির জানলার ধার এটা। এখানেই যে রোজ বেঁধে রাখা হয় তাকে!

ভাঙা কাচ দিয়ে রোদ সটান ঢুকে পড়েছে সিঁড়ির এক চিলতে এই জায়গাটায়। গরম মেঝেয় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে গলা দিয়ে গোঙানির মতো শব্দ করছিল বছর চারেকের লতিকা! তাকে দেখেই মহল্লায় খবর গিয়েছিল। জানাজানি হতে, পুলিশ এসে প়ড়ে। রবিবার এ দৃশ্য সিউড়ির ডাঙালপাড়ার একটি হোমের।

কেন বেঁধে রাখা হয়েছিল শিশুকন্যাটিকে হোমের জানলায়?

অভিযোগ, হোমের কাছে লতিকার ‘অপরাধ’— সে নাকি একটু সময় পেলেই সঙ্গীদের বিছানার চাদর, তোষক এদিক-ওদিক করে দেয়! হোম তাই টানা রোদের মধ্যে রেখে দেয় তাকে!

এ দিন কার্যত এই অভিযোগ ও শাস্তির কথা জানাজানি হতেই ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে জেলা সদর শহরে। কেন্দ্রীয় সরকার পোষিত ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পরিচালিত ওই হোম কর্তৃপক্ষ কেন এমন অমানবিক হবে, কেন এমন অসহায় একটি শিশুকে এ ভাবে শাস্তি দেওয়া হবে তা নিয়ে ক্ষুব্ধ হন এলাকাবাসী। তাঁরা হোমের উপর চড়াও হন। দরজা ধাক্কাধাক্কি করেন। ইটপাটকেল ছোঁড়েন। সিউড়ি থানার পুলিশ খবর পেয়ে হোমের সুপারকে আটক করে। কেন এবং কীভাবে শিশুটির উপর অত্যাচার হয়েছে সেটা খতিয়ে দেখছে জেলা চাইল্ড ওয়েল ফেয়ার কমিটিও। চাইল্ড লাইনের জেলা কো-অর্ডিনেটর দেবাশিস রায় জানান, এ দিন রাতে শিশুটিকে চিকিৎসার জন্য সিউড়ি হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

‘‘হাঁপাতে হাঁপাতে এসে খবর দিল এক মহিলা। বলল, সকালে কাজে গিয়েছিল তখনও দেখেছিল, বেলা তিনটের দিকে ফিরতি পথেও দেখে মেয়েটা জানলার ধারে গোঙাচ্ছে। রেলিং-এ ওই টুকুন মেয়েটাকে বাঁধা থাকতে দেখে, কান্না যেন থামছিল না। সব শুনে আমরা আর দেরি করিনি!’’ বলছিলেন ডাঙালপাড়ার বাসিন্দা রমেশ পাল। রমেশবাবু স্থানীয় স্নেহলতা নামে ওই পরিচারিকার মুখে সব শুনে স্থানীয় ভ্যান চালক উত্তম কাহারকে ডাকেন। ঘটনার কথা জানাজানি হতেই মহল্লার অনেকেই বেরিয়ে পড়েন একে একে।


এই জানালার শিকে এই দড়িতেই শিশুটিকে বেঁধে রাখা হয়েছিল বলে অভিযোগ। রবিবার সিউড়িতে। —তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় এক বাসিন্দার কথায়, ‘‘এমন ভাবে একটি শিশুর উপর অত্যাচার ভাবা যায় না! আমরা ডাকাডাকি করলেও হোমের দায়িত্বে থাকা কেউ দরজা খোলেননি। বাইরে দাঁড়িয়ে দেখি, পরিস্থিতি বেগতিক দেখে শিশুটির বাঁধন খুলে হোমের মধ্যে ঢুকিয়ে নেওয়া হয়। না জানি, ভিতরে নিয়ে গিয়ে ওকে কী করবে! তখনই তাই সকলে ঠিক করি, পুলিশকে খবর দিতে হবে। পুলিশকে ফোন করা হয়।’’

হোম কর্তৃপক্ষ অবশ্য অভিযোগ নিয়ে মুখ খোলেননি। শিশুটির কাছ থেকেও কিছু জানার উপায় নেই!

সিডাব্লুউসি, পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, অনাথ ও অসহায় শিশুদের এই হোমে রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। মোট ১২টি শিশু এখানে থাকতে পারে। জানা গিয়েছে, যে মহিলা সদস্য তদন্তে গিয়েছেন তিনি জেনেছেন অভিযোগের সত্যতা রয়েছে। গত ৭ মার্চ শিশুটিকে রামপুরহাট স্টেশন থেকে উদ্ধার করে জিআরপি। চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির হাত ধরে পরে এই হোমে তার ঠাঁই হয়। নাম রাখা হয় লতিকা। চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির চেয়ারম্যান নিত্যানন্দ রায় বলেন, ‘‘বিষয়টি শোনার সঙ্গে সঙ্গে কমিটির এক মহিলা সদস্যকে হোমে পাঠানে হয়। তিনি তদন্ত করে যে রিপোর্ট দেবেন তার ভিত্তিতে নিশ্চই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এমন ঘটনা হয়ে থাকলে সেটা অত্যন্ত নিন্দনীয় এবং চূড়ান্ত অমানবিক। এই রোদে বড়দের দাঁড় করিয়ে রাখলে তিনিও অসুস্থ হয়ে পড়বে!’’

ঘটনায় নিন্দার ঝড় শহরে। সিউড়িতেই শিশুকল্যানের কাজে জড়িয়ে রয়েছেন অনন্ত পাল। তিনি বলছেন, ‘‘এমন ঘটনা একটি শিশুর সঙ্গে ঘটেছে, এটা কল্পনার অতীত!’’

শেষ বিকেলে পুলিশ আর মহল্লা যখন একটু থিতু হয়েছে, চুপটি করে বসে লতিকাও। হাত দুটো আতঙ্কে জড়ো করা, মুখ মেঝের দিকে। হাসপাতালে গিয়েও আতঙ্ক কাঁটা সে!

জানলায় এলোমেলো হাওয়ায় তখনও ঝুলছে দড়িটা!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Child Home Locked Child
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE