Advertisement
০৪ মে ২০২৪
ঝালদায় কংগ্রেস, সোনামুখী তৃণমূলের

কুর্সি বদলের খেলায় নেই, আস্থা সেই নেপালে

তখনও ঝালদা হাইস্কুলের গেট খোলেনি। তার মধ্যেই ঝালদার প্রাক্তন পুরপ্রধান মধুসূদন কয়াল, পিন্টু চন্দ্র, প্রদীপ কর্মকার-সহ এলাকার কংগ্রেস নেতা-কর্মীরা এসে হাজির ভোটগণনা কেন্দ্রের সামনে। কী বুঝছেন? মধুসূদনবাবু হেসে বললেন, ‘‘দেখবেন এ বার আমরাই বোর্ড গঠন করব।’’ ঘণ্টাখানেক পরে সত্যিই বোঝা গেল, মধুসূদনবাবু নিছক কথার কথা বলেননি। সকাল ৯টার মধ্যেই মোটামুটি স্পষ্ট হয়ে গেল, ঝালদার মসনদে কারা বসছে।

দলকে জেতানোর কারিগর। নেপাল মাহাতোকে ঘিরে দলীয় কর্মীদের উল্লাস।

দলকে জেতানোর কারিগর। নেপাল মাহাতোকে ঘিরে দলীয় কর্মীদের উল্লাস।

প্রশান্ত পাল ও সমীর দত্ত
ঝালদা শেষ আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০১৫ ০১:২৭
Share: Save:

তখনও ঝালদা হাইস্কুলের গেট খোলেনি। তার মধ্যেই ঝালদার প্রাক্তন পুরপ্রধান মধুসূদন কয়াল, পিন্টু চন্দ্র, প্রদীপ কর্মকার-সহ এলাকার কংগ্রেস নেতা-কর্মীরা এসে হাজির ভোটগণনা কেন্দ্রের সামনে। কী বুঝছেন? মধুসূদনবাবু হেসে বললেন, ‘‘দেখবেন এ বার আমরাই বোর্ড গঠন করব।’’

ঘণ্টাখানেক পরে সত্যিই বোঝা গেল, মধুসূদনবাবু নিছক কথার কথা বলেননি। সকাল ৯টার মধ্যেই মোটামুটি স্পষ্ট হয়ে গেল, ঝালদার মসনদে কারা বসছে। হাইস্কুলের দিক থেকে দুই যুবক বাজারের দিকে ছুট লাগিয়েছেন। মুখে চিৎকার, ‘‘আমরাই জিতছি!’’ কংগ্রেসের হাত পতাকার নীচে তখনই নাচ শুরু হয়ে গেল কর্মী-সমর্থকদের। আবির খেলায় মেতে উঠলেন তাঁরা।

আর তার সঙ্গেই ঝালদার মানুষ জেনে গেলেন, এ বার অন্তত স্থায়ী পুরবোর্ড পাচ্ছেন তাঁরা।

পাঁচ বছরে তিন বার পুরপ্রধান বদল, ক্ষমতার স্বাদ পেতে নিবার্চিত প্রতিনিধিদের বারবার শিবির বদল। গত পাঁচ বছরে এমন ছবিই দেখেছেন ঝালদার মানুষ। মিউজিক্যাল চেয়ারের এই খেলায় ব্রাত্য হয়ে গিয়েছিল ঝালদার উন্নয়নের বিষয়টিই। এ বার যে স্থায়ী পুরবোর্ড চাইছেন এলাকাবাসী, এমন ইঙ্গিত মিলেছিল ভোটের আগেই। মঙ্গলবার ভোটের ফল বেরোতে দেখা গেল, স্থায়ীত্বের পক্ষেই রায় দিয়েছেন ঝালদার বাসিন্দারা। কুর্সি বদলের রাজনৈতিক খেলায় তাঁরা যে তিতিবিরক্ত, তা বুঝিয়ে দিয়েছেন ইভিএমে। ঝালদা পুরসভার ১২টি ওয়ার্ডের মধ্যে কংগ্রেস একাই ৭টি পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরষ্ঠতা পেয়েছে। সেই ২০০০ সালে শেষবার ঝালদা পুরসভায় ক্ষমতায় এসেছিল কংগ্রেস। দশ বছর পরে আবার। বামফ্রন্ট ৩টি এবং নির্দল প্রার্থীরা পেয়েছেন ২টি আসন। তৃণমূলের ঝুলিতে শূন্য! গোটা রাজ্যে যেখানে দলের অস্তিত্ব বজায় রাখতেই দিশাহারা কংগ্রেস নেতৃত্ব, এই জেলারও অন্য দুই পুরসভা পুরুলিয়া ও রঘুনাথপুরেও যেখানে গতবারের চেয়ে ভাল ফল করে ক্ষমতা ধরে রেখেছে তৃণমূল, ঝালদায় সেখানে এমনই উলটপুরাণ!

অথচ, ঝালদাকে এ বার পাখির চোখ করেছিল তৃণমূল। তারা এ বার জেলা কংগ্রেস সভাপতি নেপাল মাহাতোর খাসতালুক ঝালদায় যে ভাবেই হোক ঘাসফুল ফোটাতে চেয়েছিলেন। ক্ষমতায় না হোক অন্তত এখানে কয়েকটি আসন জিততে মরিয়া ছিলেন জেলার তৃণমূল নেতারা। দলের পুরুলিয়ার পর্যবেক্ষক তথা সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে যুবনেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, জেলা সভাপতি তথা মন্ত্রী শান্তিরাম মাহাতো-সহ একাধিক নেতা ঝালদায় প্রচারে এসেছিলেন। যদিও ঝালদার অনুন্নয়ন বা পুর-পরিষেবা সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে কখনওই তৃণমূলকে পথে নামতে দেখেননি এলাকাবাসী। পুরুলিয়া শহরের একটি সভায় নেপালবাবু তাই প্রত্যয়ী সুরে দাবি করেছিলেন, ‘‘ঝালদায় তৃণমূল খাতাই খুলতে পারবে না।’’

বাস্তবে হয়েছেও তাই। শূন্য হাতে ফিরে এতই হতাশ তৃণমূল শিবির, যে দলের স্থানীয় নেতা বিজন ঘোষ অভিযোগ করে বসলেন, ‘‘এখানে নেপালবাবুর সাথে কর্পোরেট জগতের কিছু লোকের যোগাযোগ আছে। তারা ভোট আদায়ে প্রচুর খরচ করেছে।’’ যা শুনে নেপালবাবু বলেছেন, ‘‘হারের একটা কিছু অজুহাত খাড়া করতে হয়। এটাও এক ধরনের অজুহাত ছাড়া আর কিছু নয়!’’

ঝালদায় যে তাঁরা সংগঠনই গড়ে তুলতে পারেননি, তা মেনে নিয়েছেন শান্তিরামবাবু। তাঁর বক্তব্য, ‘‘ওখানে আমাদের সংগঠন দুর্বল। তা ছাড়া, আমাদের দলে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁরা অন্য দলে (কংগ্রেস) যাওয়ারও একটা প্রভাব পড়েছে।’’ কিন্তু, দলের কর্মীরা বলছেন, জেলা নেতারা প্রথম থেকে গুরুত্ব দেননি ঝালদাকে? তাঁর জবাব, ‘‘সেটা ঠিক নয়। এ বার সে দিকে নজর দেওয়া হবে।’’ দলেরই জেলা কার্যকরী সভাপতি সুজয় বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য মনে করেন, আরও আগেই ঝালদায় সংগঠন শক্ত করার কাজে দলের নামা উচিত ছিল।

শুধু তৃণমূল নয়, ঝালদায় দাঁত ফোটাতে পারেনি বিজেপি-ও। বছরের গোড়ায় ঝালদা কলেজের ছাত্র সংসদ ভোটে ক্ষমতা দখলের দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিল এবিভিপি। পরে ছাত্র পরিষদ ও তৃণমূল ছাত্র পরিষদ যৌথ ভাবে বোর্ড গড়ে এখানে। এই বিষয়টি মাথায় রেখে বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ এখানে সভা করে গিয়েছেন। বিজেপি-র হয়ে প্রচারে এসেছেন ঝাড়খণ্ডের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অর্জুন মুন্ডা। পুরভোটে অবশ্য এ সব কোনও প্রভাবই ফেলতে পারেনি। বস্তুত, কলেজের ভোটের সাফল্যের পরে ঝালদায় কোনও আন্দোলন দড়ে তুলতে পারেনি বিজেপি। স্থানীয় সমস্যাগুলি নিয়ে সে ভাবে তারা পথে নামেনি। অন্য দিকে, বামফ্রন্ট এ বার ৩টি আসন পেলেও গত বার (২০১০) কিন্তু তারা ছ’টি আসন পেয়ে (একজন নির্দল-সহ) পুরবোর্ড গড়েছিল। পরে বাম কাউন্সিলরদের আস্থাভোটে নিজেদেরই দলকে হারিয়ে কংগ্রেসকে বোর্ডে আনেন। পুরপ্রধান হন কংগ্রেসের প্রদীপ কর্মকার। গত বছর অনাস্থা এনে প্রদীপবাবুকে সরিয়ে পুরপ্রধান হন নির্দল সুরেশ অগ্রবাল। বারবার ক্ষমতার অলিন্দে রদবদল হওয়ায় ঝালদার উন্নয়নই ব্রাত্য থেকে গিয়েছে। সব মিলিয়ে বিভিন্ন পক্ষের পুরসভা দেখেছেন ঝালদাবাসী। শেষমেশ তাঁদের সিংহভাগের রায় গিয়েছে কংগ্রেসের পক্ষেই।

জেতার আনন্দে তুমুল নাচ।

কংগ্রেসের সাফল্যের কারণ কী?

এলাকার বাসিন্দা উত্তম স্বর্ণকার কিংবা বুলু চন্দ্র এই কৃতিত্ব নেপালবাবুকেই দিচ্ছেন। বলছেন, ‘‘কাজের মানুষ নেপালবাবুর মাহাতোর প্রতি আমাদের আস্থা রয়েছে। ভোটের ফল তারই প্রমাণ।’’ গত লোকসভা নিবার্চনে যেখানে ঝালদা পুর-এলাকা থেকে তাঁর লিড হাজারেরও কম ছিল, এ বার সেখানে তাঁর দল সাতটি আসন জিতেছে। নেপালবাবুর কথায়, ‘‘মানুষ আমাদের উপরে বিশ্বাস ও আস্থা রেখেছেন। এখানে নির্দল প্রার্থীদের একটা অংশ টাকা পয়সা দিয়ে ভোটে প্রভাব ফেলার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু মানুষ এই বিষয়টি সমর্থন করেননি।’’ শহরের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যাচ্ছে, প্রথমত, তাঁরা স্থায়ী পুরবোর্ড চেয়েছিলেন। তাঁরা মনে করেছেন, ঝালদার ভূমিপুত্র নেপাল মাহাতোর নেতৃত্বে কংগ্রেসই স্থায়ী বোর্ড দিতে পারবে। দ্বিতীয়ত, ঝালদায় একদা কংগ্রেসের সঙ্গে থাকা একাধিক নেতা তৃণমূলে গিয়েও ভোটের আগে ফের কংগ্রেসে ফিরে এসেছেন। ফিরেছেন প্রদীপ কর্মকার, মধুসূদন কয়াল, জগন্নাথ রজকের মতো নেতারা। প্রদীপবাবু বিগতে বোর্ডে ঝালদার পুরপ্রধানও ছিলেন। তাঁরা কংগ্রেসের হাত শক্ত করেছেন।

ঝালদার কংগ্রেস নেতারা জানাচ্ছেন, লোকসভা ভোটের পরে নেপালবাবু নিজে এখানকার সংগঠন নিয়ে পড়ে থেকেছেন। তৃণমূল, বিজেপি যখন প্রতিষ্ঠিত নেতা-নেত্রীদের নিয়ে এসে এখানে প্রচারে ঝড় তুলেছে, সেখানে কংগ্রেসের কোনও তাবড় নেতাই এখানে আসেননি। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী জেলায় সভা করতে এলেও ঝালদায় যাননি। বরং নেপালবাবুই এখানে বিভিন্ন ওয়ার্ডে সভা করেছেন। মানুষকে বারবার বলেছেন, ‘‘আমরা পাশে আছি।’’

মঙ্গলবার জয়ের পরে দৃশ্যতই তৃপ্ত নেপালবাবু তাই বলছেন, ‘‘এখন ঝালদার মানুষের জন্য কাজ করাই আমাদের লক্ষ্য। তৃণমূল দল ভাঙানোর যে খেলায় মেতেছিল, আমাদেরও কয়েক জনকে ভাঙিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, মানুষ তার বিরুদ্ধেও জবাব দিয়েছেন।’’

ছবি: প্রদীপ মাহাতো।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE