Advertisement
১৭ মে ২০২৪
আজ যাচ্ছেন ব্রিগেডে

ঘুরে দাঁড়িয়ে দলকে সাহস জোগাচ্ছেন প্রবীণ ধীরেন

উপরের ক্ষত শুকিয়েছে। যন্ত্রণা এখনও পুরোপুরি কমেনি। ভিতরের আঘাত আরও মারাত্মক। কিন্তু, তা সত্ত্বেও তিনি যে লড়াই থেকে পিছু হটার লোক নন, তার প্রমাণ দিলেন সত্তরের যুবক ধীরেন লেট।

ষাটপলশা। ২১ নভেম্বর ’১৫।

ষাটপলশা। ২১ নভেম্বর ’১৫।

দয়াল সেনগুপ্ত
সিউড়ি শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০১৫ ০১:০৮
Share: Save:

উপরের ক্ষত শুকিয়েছে। যন্ত্রণা এখনও পুরোপুরি কমেনি। ভিতরের আঘাত আরও মারাত্মক। কিন্তু, তা সত্ত্বেও তিনি যে লড়াই থেকে পিছু হটার লোক নন, তার প্রমাণ দিলেন সত্তরের যুবক ধীরেন লেট।

প্রকাশ্যে হেনস্থা হওয়ার পরেও চার বারের সিপিএম বিধায়ক ও প্রাক্তন জেলা সভাধিপতি ধীরেনবাবু দলের কর্মসূচিতে পুরো দমে যোগ দিয়েছেন। তাঁর বাড়ি পারুলিয়ায়। সেখান থেকে ছ’কিমি দূরের ময়ূরেশ্বর জোনাল কার্যালয়ে নিয়মিত আসছেন। এ ছাড়াও, ময়ূরেশ্বর বা জেলার অন্য প্রান্তে দলের বিভিন্ন কর্মসূচিতে, যেখানেই সাধারণের অধিকার নিয়ে কথা বলার সুযোগ রয়েছে, সেখানেই হাজির তিনি। তাঁর বাড়ি থেকে কখনও কখনও ৪০ থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরের জায়গাতেও ঠিক গিয়ে উপস্থিত হচ্ছেন তিনি।

অথচ ২১ নভেম্বরের ঘটনার পরে তাঁর দলেরই তরু‌ণ প্রজন্মের অনেকের মানসিক জড়তা কাটেনি। সে দিন প্রকাশ্যে নিগ্রহ করা হয় প্রবীণ ধীরেনবাবুকে। দলীয় কর্মসূচিতে ময়ূরেশ্বরে আয়োজিত জাঠায় অংশ নিয়ে মিছিলে হাঁটার সময় আক্রান্ত হয়েছিলেন ধীরেনবাবু সহ জেলার বাম নেতারা। অভিযোগ ছিল তৃণমূল বিরুদ্ধে। বেধড়ক মারে মাথা ফাটে তাঁর। আঙুলও ভাঙে। তারপরেও তাঁর মতো প্রবীণ রাজনীতিককে রেহাই দেয়নি হামলাকরীরা। কান ধরে উঠবস করিয়ে রাজনীতি না করার অঙ্গীকার করতে জোর করেছিল দুষ্কৃতীরা। এমন রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতার শিকার হতে পারেন, তা ভাবতেও পারেননি ধীরেনবাবু। মারাত্মক জখম নিয়ে সাত দিন সিউড়ি হাসপাতলে ভর্তি ছিলেন।

এক সিভিক ভলান্টিয়ার-সহ ১০ জনের নামে অভিযোগ করেছিলেন সিপিএম নেতারা। ধীরেনবাবুর প্রতি অত্যাচার ও সেই অত্যাচারের ভিডিও ছবি তুলে রাখার অভিযোগও ছিল ওই সিভিক ভলান্টিয়ারের বিরুদ্ধে। কিন্তু, পুলিশ অভিযুক্তের তালিকায় থাকা চার জনকে মাত্র ধরেছে। ধরা পড়েনি অভিযুক্ত সিভিক ভলান্টিয়ারও। বাম নেতাদের দাবি, দুষ্কৃতীরা শাসকদের ছত্রছায়ায় থাকায় প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও তাঁদের ধরছে না পুলিশ।

এই পরিস্থিতিতে ধীরেনবাবুর মতো প্রবীণ নেতা অকুতোভয়ে নিজের কাজ করে চলেছেন। সেই সাহসকে কুর্নিস জানাচ্ছেন দলীয় নেতারা।

দলের নেতারাই জানাচ্ছেন, যেখানে ঘটনাটি ঘটেছিল, ময়ূরেশ্বরের সেই ষাটপলসায় এখনও জড়তা কাটেনি দলের কর্মী সমর্থকদের। শাসক দলের অত্যাচারের ভয়ে তাঁরা এখনও দ্বিধায়। এক বাম নেতা বলেন, ‘‘সেখানে ধীরেনদা যে সাহস দেখালেন, তা অন্যের কাছে অনুপ্রেরণা।’’

ধীরেনবাবুও জানান, যাঁরা অত্যাচার চালানোর মূলে, তাঁরা দিব্যি ঘুরে বেরাচ্ছে। কিন্তু পুলিশ বলছে ওদের নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাঁর কথায়, ‘‘পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধেও আমাদের লড়াই জারি থাকবে।’’

সেভ ডেমোক্রেসি ফোরামের রাজ্য সম্পাদক চঞ্চল চক্রবর্তীরও দাবি, পুলিশ নিষ্ক্রিয়। তিনি বলছেন, ‘‘এত জন বাম নেতার উপরে এমন বর্বরোচিত হামলায় যারা অভিযুক্ত, তাঁদের উপর শাসকদলের হাত থাকায় পুলিশ তাদের ধরছে না।’’ তিনি জানান, দিন কয়েক আগে সিউড়িতে গিয়ে ডিএসপি-র সঙ্গে দেখা করে এর প্রতিবাদও করেছেন। চঞ্চলবাবু বলেন, ‘‘ডিএসপি কথা দিয়েছিলেন যে, অভিযুক্তদের ধরা হবে। কিন্তু সেটা কথাতেই থেকে গিয়েছে।’’

পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়েরের পাশাপাশি হাইকোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলাও হয়েছে এই ঘটনার প্রেক্ষিতে। পুলিশের তরফে অবশ্য এই বিষয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া মেলেনি।

কিন্তু যেখানে তরুণ নেতারাই খানিকটা গুটিয়ে রয়েছেন, সেখানে ধীরেনবাবু কী করে আবার পূর্ণ উদ্যমে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারলেন? দলের নেতাদের জবাব, ‘‘আসলে ধীরেনদা মাঠের লোক, কাজের লোক। সাধারণ জীবন যাপন। দেখনদারিতে কোনও দিনই বিশ্বাসী নন। সেই জন্যই তিনি এ ভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারলেন।’’

ধীরেনবাবুর নিজের কথায়, ‘‘নিজের সম্ভ্রম বাঁচাতে সে দিন ওদের দাবি মেনে কান ধরে রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার কথা বলতে বাধ্য হয়েছিলাম। কিন্তু খুব অপমানিত হলেও রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবিনি। সাধারণ মানুষের অধিকারের লড়াই করবার জন্যই তো রাজনীতিতে আসা।’’

সেই ৬৭ সাল থেকে ধীরেনবাবু সক্রিয় রাজনীতিতে। কৃষক আন্দোলন থেকে শুরু। নিজের কোনও জমি নেই। সেই ৮২ সাল থেকে ৯৮ সাল পর্যন্ত চার বার বিধায়ক হিসাবে থাকার পরে ৯৮-এর জুলাইয়ে জেলা পরিষদের সভাধিপতি হন ধীরেনবাবু। তাঁর স্ত্রী সন্ধ্যাদেবীও সক্রিয় ভাবে রাজনীতিতে যুক্ত। তিনি বলছেন, ‘‘আমি সব সময় ওঁর পাশে রয়েছি। ঘুরে না দাঁড়ালে মানুষের জন্য কথা বলার সুযোগ থাকবে না।’’ পাশে দাঁড়াচ্ছেন ওঁর মেয়েরাও।

ধীরেনবাবুর এত দিনের রাজনৈতিক জীবনেও কোনও বিলাসিতা নেই। এখনও যাতায়াতের বাহন সাইকেল। পরিবার আর মনের জোরই প্রবীণ এই নেতার সব থেকে বড় সম্পদ।

আজ, কলকাতায় ব্রিগেডের সভায় যোগ দিয়ে দলকে ঘুরে দাঁড়াতেই ভরসা জোগাতে চান প্রত্যয়ী ধীরেন লেট।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

state news cpim brigade
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE