Advertisement
০১ মে ২০২৪

ঘুম ভাঙতেই সামনে মহাকাল

রাত তখন কত, জানি না! মচমচ শব্দ শুনেই হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলেই দেখি, আমার কুঁড়ে ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে সাক্ষাৎ সে। যমদূতের মতো মস্ত এক হাতি!

বামাপদ মণ্ডল
শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০১৫ ০১:৫২
Share: Save:

রাত তখন কত, জানি না!

মচমচ শব্দ শুনেই হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলেই দেখি, আমার কুঁড়ে ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে সাক্ষাৎ সে। যমদূতের মতো মস্ত এক হাতি!

ততক্ষেণে সে শুঁড় ঢুকিয়ে দিয়েছে শুকনো ডালপালা দিয়ে তৈরি ঘরের বেড়ার মধ্যে। পাশে শুয়ে তখন অঘোরে ঘুমোচ্ছে খগেন। দিন কয়েক আগে দুর্গাপুরে আমার সঙ্গে ওর পরিচয়। বর্ধমানে ওঁর বাড়ি। বিয়ে থা করেনি। বলেছিল, ‘‘সাধুবাবা তোমার কুটিরে যাব।’’ বলেছিলাম, ‘‘ভালই তো, দিন কয়েকের জন্য এসো।’’

এসে‌ছিল!

এসে বলেছিল ‘‘সাধুবাবা কিছুদিন থাকব।’’

সাধুবাবা— এই নামেই এলাকার লোকে আমাকে ডাকে, খগেনও ডাকছিল।

বছর আটেক আগে গেরুয়া নিয়ে সংসার ছেড়েছি। মা কালীর ভক্ত আমি। ভেবেছিলাম, লোকলয় থেকে দূরে কোথাও ছোট কুটির বানিয়ে থাকব। সেই ভেবেই বছর দেড়েক আগে একসময় রাজনগরের রানিগ্রাম ও সাহাবাদ গ্রামের মধ্যে জঙ্গল ঘেঁষে ছোট্ট কুঁড়ে বানিয়েছি। খড়ের চাল আর শুকনো কাঠকুটো দিয়ে আড়াল দিয়ে ঘরের মতো একটা আস্তানা।

কাছাকাছি থাকা মানুষজন যখন যে যেটা দেন তাতেই চলে যায় আমার।

আমি রাজি হয়েছি দেখে, খগেন বৃহস্পতিবার আমার কাছে চলে এসেছিল। নির্জন কুঁড়েতে এমনিতেই একা থাকি। খগেন আসায় ভাল লেগেছিল। দুটো সেদ্ধ ভাত খেয়ে দুজনেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভেঙে বেড়ার ফাঁকে রাতের হালকা আলোয় বিশাল কালো হাতি দেখে বুকের মধ্যে যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছিল। মনে হল আজই সব শেষ!

তবুও চাপা স্বরে খগেনকে ডেকে তুললাম। দুজনেই আস্তে আস্তে উঠে বসলাম। মনে হল, হাতিটা ঠিক আমাদেরকেই লক্ষ্য করে যাচ্ছে। কয়েক মূহূর্ত একই ভাবে কাটল। হঠাৎ হতিটা অন্যদিকে মুখ ঘোরাতেই, খগেনকে বললাম চলো পালাই যদি বাঁচতে চাও। কুঁড়ের বেড়া খুলে দুজনেই বেড়িয়ে যেই দৌড় শুরু করেছি, হাতিটা অমনি আমাদের পিছু নিল। কুঁড়ের কাছেই একটা পুকুর(কানাগড়ে) আছে ওই দিকটায় ছুটতে ছুটতেই খগেন বলছিল, ‘‘সধুবাবা আমি পারছি না।’’

আমি ওকে বললাম, ‘‘দৌড়াও। আমি পুকুরের পাড়ের দিকে এগোচ্ছি।’’

একটু পরে দেখি খগেন নেমে গেল পুকুরের মধ্যে। কী আক্রোশে খগেনের পিছনে পিছনে পুকুরে নেমে পড়ল হাতিটাও। আমি প্রাণ ভয়ে বেশ কিছুটা দৌড়ে দুটো ধান খেত পেরিয়ে কাদার মধ্যে পড়ে যাই। আর উঠার ক্ষমতা ছিল না। শুধু ভয় হচ্ছিল, এই বুঝি হাতিটা এল। চুপ করে পড়ে রইলাম বেশ কিছুক্ষণ। আনুমানিক ঘণ্টা দেড়েক কাটার পর, ভোরের আলো ফুটে উঠল। তারপর রানিগ্রামের কেউ যেন পুকুরে এল। মানুষের আওয়াজ পেয়ে সর্বশক্তি দিয়ে ডাকলাম তাঁকে। তাঁর মাধ্যমে খবর পেয়ে গ্রামবাসীরা এল।

আস্তে আস্তে উঠে পুকুরে এসে দেখি পুকুরের ধারে নরম মাটিতে হাতিটার পায়ের ছাপ। আর খগেনের নিথর দেহটা পুকুরের জলে পড়ে রয়েছে!

বুনোহাতিটা ওকে নির্মম ভাবে শেষ করে দিয়ে গেছে। বুনোহাতি ভয়ঙ্কর হয় জানতাম, কিন্তু আমরা তো হাতিটার কোনও ক্ষতি করিনি।

কুঁড়েতেই থাকব, কোথায় আর যাব। কিন্তু চোখের পাতা বুজতে পারব কিনা জানি না!

এখনও খালি মনে পড়ছে, চোখ খুলতেই দেখা কালোপাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকার ওই দৃশ্যটা!

(রাজনগরে হাতির হামলা থেকে রক্ষা পাওয়া সাধুবাবা)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

elephant villagers purulia
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE