Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

দ্বীপ হয়েই জলবন্দি বিলে গ্রাম

ময়ূরাক্ষী নদীতে জল বাড়ায় জলবন্দি হয়ে পড়েছে লাভপুরের বিলে গ্রাম। বন্দিদশা অবশ্য ওই গ্রামের এই নতুন নয়। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই বছরের পর বছর বর্ষার মরসুমে জলবন্দি অবস্থায় কাটাতে হচ্ছে ওই গ্রামের বাসিন্দাদের। অথচ উপায় থাকা সত্ত্বেও তাঁদের বন্দিদশা ঘোঁচাতে কোনও প্রশাসনিক উদ্যোগ নেই বলেই অভিযোগ।

তিলপাড়া থেকে ছা়ড়া জলে সাঁইথিয়ায় ভেসে গিয়েছে ময়ূরাক্ষীর উপরে থাকা অস্থায়ী সেতু। বিপজ্জনক ভাবে রেলসেতু দিয়েই পারাপার করছেন বাসিন্দারা। ছবি: অনির্বাণ সেন।

তিলপাড়া থেকে ছা়ড়া জলে সাঁইথিয়ায় ভেসে গিয়েছে ময়ূরাক্ষীর উপরে থাকা অস্থায়ী সেতু। বিপজ্জনক ভাবে রেলসেতু দিয়েই পারাপার করছেন বাসিন্দারা। ছবি: অনির্বাণ সেন।

নিজস্ব সংবাদদাতা
লাভপুর শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০১৫ ০২:৪২
Share: Save:

ময়ূরাক্ষী নদীতে জল বাড়ায় জলবন্দি হয়ে পড়েছে লাভপুরের বিলে গ্রাম। বন্দিদশা অবশ্য ওই গ্রামের এই নতুন নয়। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই বছরের পর বছর বর্ষার মরসুমে জলবন্দি অবস্থায় কাটাতে হচ্ছে ওই গ্রামের বাসিন্দাদের। অথচ উপায় থাকা সত্ত্বেও তাঁদের বন্দিদশা ঘোঁচাতে কোনও প্রশাসনিক উদ্যোগ নেই বলেই অভিযোগ।

গত শনিবার দু’ জায়গায় কুঁয়ে নদীর বাঁধ ভেঙে জলমগ্ন হয়ে পড়ে লাভপুরের ৫০টিরও বেশি গ্রাম। ওই সব গ্রাম থেকে জল সরলেও এখনও ঘরে ফিরতে পারেননি অধিকাংশ বন্যা দুর্গত পরিবার। অস্থায়ী আশ্রয়ে দিন কাটছে তাঁদের। তারই মধ্যে শুক্রবার বিভিন্ন জলাধার থেকে জল ছাড়ার খবরে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন তাঁরা। ওই সব গ্রাম শনিবার বিকেল পর্যন্ত নতুন করে প্লাবিত না হলেও বিলে গ্রামে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় উদ্বিগ্ন ব্লক প্রশাসন।

প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রের খবর, ওই গ্রামে প্রায় ৫০টি পরিবারের বাস। গ্রামের এক দিকে বয়ে গিয়েছে ময়ূরাক্ষী নদী। অন্য দিকে, গ্রামকে দ্বীপের মতো মাঝে রেখে সাঁইথিয়া থেকে একটি কাঁদর এসে মিশেছে পাশের তরুলিয়া গ্রাম লাগোয়া ময়ূরাক্ষী নদীতে। সিউড়ি, সাঁইথিয়া-সহ বিভিন্ন এলাকার বহু সেচখাল এবং বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মাঠভাসি জল ওই কাঁদর বেয়ে মেশে ময়ূরাক্ষী নদীতে। কিন্তু, ময়ূরাক্ষীতে জল বাড়লে তা উজানে কাঁদর বেয়ে পৌঁছে যায় গ্রামে। ওই সময় কাঁদরে বেয়ে আসা জল নিষ্কাশনের পথ না পেয়ে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ করে তোলে। তখন অনির্দিষ্ট কালের জন্য জলবন্দি হয়ে পড়েন গ্রামের মানুষ। কারণ, ওই গ্রাম থেকে বাইরে বেরোনোর অন্যতম মাধ্যম হল কাঁদরের উপর নির্মিত বাঁশের সাঁকো কিংবা নৌকো। কিন্তু, জলের তোড়ে ফি বছর ভেসে যায় বাঁশের সাঁকো। তলিয়ে যায় নৌকোও। নদী বাঁধ দিয়ে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরের সাঁইথিয়া যাওয়ার একটি রাস্তা অবশ্য রয়েছে। বছরের অন্যান্য সময় ওই রাস্তা বিকল্প হিসাবে কাজে লাগলেও বর্ষায় নদী বাঁধের অবস্থাও চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে। তা ছাড়া ওই গ্রামের স্কুল-কলেজ, বাজার-হাট, থানা, হাসপাতাল, ব্লক— সবই লাভপুর কেন্দ্রিক। কাঁদর পেরিয়ে লায়েকপুর গ্রামে পৌঁছে তবেই ওই সব জায়গায় যাওয়ার সুযোগ পান গ্রামের বাসিন্দারা। কিন্তু, ময়ূরাক্ষীতে জল বাড়লেই তাঁদের সেই সুযোগ হারাতে হয় বলে গ্রামবাসীদের দাবি।

এ বারও সেই একই দুর্ভোগের মুখে পড়তে হয়েছে গ্রামবাসীদের। শুক্রবার তিলপাড়া জলাধার থেকে দফায় দফায় জল ছাড়ায় ময়ূরাক্ষী নদীর জলস্ফীতি কাঁদর বেয়ে পৌঁছে গিয়েছে গ্রামে। অন্য দিকে, টানা বৃষ্টিতে কাঁদরের জলও বেরোনোর পথ না পেয়ে কার্যত ফুঁসে উঠেছে। এ দিন দুপুর ২টো নাগাদ গিয়ে দেখা গেল দ্বীপের মতো জেগে রয়েছে গ্রাম। ভেসে গিয়েছে বাঁশের সাঁকোও। তখনও পৌছয়নি প্রশাসনের নৌকো। তবে, ঘটনাস্থলে হাজির হয়েছেন সংশ্লিষ্ট লাভপুর ব্লক দুর্যোগ মোকাবিলা আধিকারিক মৃত্যুঞ্জয় মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘গ্রামবাসীদের ব্যবহারের জন্য ২০১৩ সালে একটি নৌকো দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে তা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সেই খবর পাওয়ার পরেই ফের নৌকো বরাদ্দ করা হয়েছে। শীঘ্রই তা এসে পড়বে। তা ছাড়া সব রকম পরিস্থিতির মোকাবিলায় আমরা সজাগ রয়েছি।’’

গ্রামবাসীরা অবশ্য ওই সাময়িক সমাধানে সন্তুষ্ট হতে নারাজ। তাঁরা চান পাকা সেতু। লাভপুর কলেজের বিএ তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী সীমা পাল, দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র কেশব পাল, ভালকুঠি হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী তৃপ্তি পাল, বুলটি বাগদিরা বলছেন, ‘‘প্রতি বছর বর্ষায় আমাদের স্কুল-কলেজ যাওয়া দীর্ঘ দিন বন্ধ হয়ে যায়। বিপদের আশঙ্কায় নৌকোয় যেতেই দেন না বাড়ির লোকেরা। তাই প্রতি বছরই আমাদের পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়তে হয়।’’ অন্য দিকে, বিশ্বনাথ মণ্ডল, জয়ন্ত মণ্ডলরা জানান, এই সময় সব থেকে সমস্যা হয় রাতবিরেতে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে। নৌকোয় কিংবা নদীবাঁধ দিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে বহু রোগীর মৃত্যুও হয়। তবুও প্রশাসনের টনক নড়েনি বলে তাঁদের ক্ষোভ। গ্রামের বাসিন্দা নিমাই দলুই, সাগর পাল, উত্তম মণ্ডল, সুখেন মণ্ডলরা বলছেন, ‘‘পুরুষানুক্রমে আমরা এই জলযন্ত্রণা ভোগ করছি। উপায় থাকা সত্ত্বেও প্রশাসন আমাদের ওই যন্ত্রণা দূর করার কোনও চেষ্টাই করেনি।’’

এমনকী, তাঁদের এও অভিযোগ, বছর কয়েক আগে পঞ্চায়েত সমিতির পক্ষ থেকে পাকা সেতু নির্মাণের টেন্ডার ডাকা হয়। কিন্তু, বরাদ্দ টাকায় সেতু নির্মাণ সম্ভব নয় বলে কোনও ঠিকাদার এগিয়ে আসেননি। প্রশাসন বরাদ্দ বাড়ানোর পরিবর্তে প্রকল্প বদলে ওই টাকা অন্যত্র কাজে লাগিয়ে দিয়েছে। কিন্তু, তার পর আর সেতু নির্মাণে কোনও উদ্যোগ নেয়নি। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে লাভপুর বর্তমান বিডিও জীবনকৃষ্ণ বিশ্বাস বলেন, ‘‘সেতুর টেন্ডার সংক্রান্ত বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখছি। তবে, ওই গ্রামবাসীদের সেতুর দাবি খুবই সঙ্গত। আমরাও এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করে সেতু নির্মাণের ব্যাপারে যথাযথ উদ্যোগ নেব। ’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Luvpur Flood P Mohan Gandhi\ river
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE