Advertisement
০২ মে ২০২৪

বাঁকুড়া মেডিক্যালে শ্যাম বাদ

ভোটে হেরে গিয়েছেন। চলে গিয়েছে মন্ত্রিত্বও। রাজ্যের বহু পরাজিত মন্ত্রীকে প্রশাসনিক গুরুত্বপূর্ণ পদ দিয়ে পুনর্বাসন দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু সেই তালিকায় ঠাঁই পাননি প্রাক্তন মন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। এ বার বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান পদ থেকেও শ্যামবাবুকে সরিয়ে দেওয়া হল।

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ১৫ জুন ২০১৬ ০৭:৫৯
Share: Save:

ভোটে হেরে গিয়েছেন। চলে গিয়েছে মন্ত্রিত্বও। রাজ্যের বহু পরাজিত মন্ত্রীকে প্রশাসনিক গুরুত্বপূর্ণ পদ দিয়ে পুনর্বাসন দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু সেই তালিকায় ঠাঁই পাননি প্রাক্তন মন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। এ বার বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান পদ থেকেও শ্যামবাবুকে সরিয়ে দেওয়া হল। ওই পদে বসানো হয়েছে বাঁকুড়ার প্রাক্তন বিধায়ক মিনতি মিশ্রকে।

স্বাস্থ্য ভবনের এই নির্দেশিকা এসে পৌঁছতেই শোরগোল পড়ে গিয়েছে বাঁকুড়া জেলা তৃণমূলের অন্দরে।

ঘটনা হল, রাজ্যের মন্ত্রী হিসেবে এতদিন বাঁকুড়া মেডিক্যাল ও বিষ্ণুপুর জেলা হাসপাতালের রোগীকল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান পদে ছিলেন শ্যামবাবু। এ বার বাঁকুড়া থেকে তাঁকে সরিয়ে আর এক পরাজিত প্রার্থীকে ওই পদ দিয়ে দল পক্ষান্তরে শ্যামবাবুর ডানা ছাঁটল কি না তা নিয়েই গুঞ্জন শুরু হয়েছে রাজনৈতিক মহলে। যে শহর এতদিন শ্যামবাবুর কথায় চলত, সেই বিষ্ণুপুরের মানুষই এ বার ইভিএম-এ জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা শ্যামবাবুকে চান না। দলেও তিনি কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। এমনকী তাঁর ঘনিষ্ঠ বলয়ে যে সব কাউন্সিলররা ছিলেন, তাঁদের অনেকেই বিধানসভা ভোটের আগে থেকে দূরে সরে গিয়েছেন। ফলে তাঁর বাঁকুড়া মেডিক্যাল থেকে পদ চলে যাওয়া নিয়ে গুঞ্জনের অন্ত নেই।

শ্যামবাবুর ঘনিষ্ঠ বিষ্ণুপুর পুরসভার এক কাউন্সিলরের আক্ষেপেও যেন সেই সুর। তিনি বলেছেন, ‘‘ভোটে হারার পর থেকেই দলকে সে ভাবে পাশে পাচ্ছেন না দাদা। দলের তরফে কিছু পরাজিত মন্ত্রীকে সম্মানজনক প্রশাসনিক পদে পুনর্বাসন দেওয়া হলেও সেই তালিকায় রাখা হল না শ্যামবাবুকে। কখনও দলের অন্দরে, কখনও প্রকাশ্যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দলের পরাজিত প্রাক্তন মন্ত্রীদের হেরে যাওয়া নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন। একবারও কিন্তু শ্যামবাবুর নাম দলনেত্রী উচ্চারণ করেছেন বলে শোনা যায়নি।’’ শ্যামবাবুর ঘনিষ্ঠ এক তৃণমূল নেতার আশঙ্কা, “দেওয়ালে কার্যত পিঠ ঠেকে যাওয়া অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর মরিয়া চেষ্টা করছেন দাদা (শ্যামবাবু)। সেই সময় এই খবর নতুন করে আমাদের মনোবলে ধাক্কা দিল! আর কত দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে কি জানি!”

বিষয়টি নিয়ে অবশ্য তেমন একটা উৎসাহ দেখাচ্ছেন না শ্যামবাবু নিজে। ফোনে এ নিয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলে তিনি শুধু বলেন, “শুনেছি বাঁকুড়া মেডিক্যালের রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যানের পদ থেকে আমাকে সরানো হয়েছে। তবে বিষ্ণুপুর হাসপাতালের ওই পদে আমাকে রাখা হয়েছে।”

বস্তুত, বিধানসভা ভোটে শ্যামবাবু হেরে যাওয়ার পর থেকে দলেরই তাঁর বিরোধী গোষ্ঠীর লোকজন বিষ্ণুপুর পুরসভার পুরপ্রধানের পদ থেকেও তাঁকে সরাতে উঠেপড়ে লেগেছেন। শ্যামবাবুর বিরুদ্ধে দলের রাজ্য নেতাদের কাছে তাঁরা বেশ কিছু অভিযোগ এনেছেন। শ্যামবাবুর অনুগামীরা অবশ্য এই সব অভিযোগ অস্বীকার করছেন। তবে বিষ্ণুপুর শহরেও ক্রমশ শ্যামবাবু বিরোধী শক্তি মাথা চাড়া দিচ্ছে বলে সম্প্রতি তা নজরে এসেছে রাজনীতি নিয়ে সচেতন মানুষজনের নজরে।

বিধানসভা ভোটে শহরের ১৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৫টিতেই হেরেছেন শ্যামবাবু। এরপর কিছুদিন আগেই বিষ্ণুপুরের বিধায়ক তুষারকান্তি ভট্টাচার্যের উপরে শ্যামবাবুর উপস্থিতিতে হামলা চালানোর অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। ওই ঘটনার প্রতিবাদে শ্যামবাবুকে গ্রেফতারের দাবিতে বিষ্ণুপুর শহরে বন্‌ধের ডাক দেয় কংগ্রেস। খোদ শ্যামবাবু নিজে মোটরবাইকে পথে নেমে ওই বন্‌ধ রুখতে চেষ্টা করেন। কিন্তু বিষ্ণুপুরের প্রাণকেন্দ্র চকবাজার-সহ শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় দোকান তিনি খোলাতে পারেননি।

অনেকেরই মতে, এতদিন বিষ্ণুপুর পরিচালনা করতেন শ্যামবাবুই। শহরে তাঁর বিরোধী বলে কেউ ছিলেন না। কিন্তু ওই বন্‌ধের সাফল্য শহরে শ্যামবাবুর প্রভাব কমে আসারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই অবস্থায় পায়ের নীচে শক্ত মাটি পেতে শ্যামবাবু তৃণমূলের জেলা সভাপতির পদের জন্য মরিয়া হয়ে মাঠে নেমেছেন বলেও তৃণমূল সূত্রের খবর। নিজের অনুগামীদের নিয়ে প্রায়ই যাতায়াত করছেন কলকাতার রাজ্য নেতাদের কাছে। তবে এ ক্ষেত্রেও তিনি হালে পানি পাবেন কি না তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন জেলা নেতাদেরই কেউ কেউ। আগামী শনিবার কলকাতায় জেলা নেতাদের নিয়ে সভা করবেন মমতা। সেখানে এই প্রশ্নেরও উত্তর মিলতে পারে বলে দল সূত্রে ইঙ্গিত মিলছে।

প্রশাসন সূত্রে খবর, রাজ্য সরকারের তরফে রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যানের নাম ঠিক করে তা স্বাস্থ্য ভবনে পাঠানো হয়। স্বাস্থ্যভবন সেই নামে স্বীকৃতির শিলমোহর বসিয়ে তা সংশ্লিষ্ট মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে পাঠায়। ওই সমিতিতে সাধারণত স্থানীয় বিধায়ক, পুরসভার জনপ্রতিনিধিদের পাশাপাশি হাসপাতাল ও জেলা প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাদের প্রতিনিধিদের সদস্য হিসেবে রাখা হয়। বাঁকুড়া মেডিক্যালের একাধিক আধিকারিক জানাছেন, ওই সমিতিতে চেয়ারম্যান কাকে করা হবে, তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট ভাবে কোন নিয়ম নেই। সবটাই সরকার তথা শাসকদলের শীর্ষনেতৃত্বের উপর নির্ভর করে। তবে শাসকদলের প্রাক্তন বিধায়কদের ওই সমিতির চেয়ারম্যান করার নজির অতীতে ছিল কি না তা তাঁরা স্মরণ করতে পারছেন না।

সেই দিকটি নিয়েই কটাক্ষ করছেন ওই দুই বিধানসভা কেন্দ্রের নতুন বিধায়কেরা। বিষ্ণুপুরের কংগ্রেস বিধায়ক তুষারকান্তি ভট্টাচার্য বলেন, “মানুষের তাঁর প্রতি আস্থা নেই বলেই ভোটে হেরেছেন শ্যামবাবু। তারপরেও কেন তাঁকে বিষ্ণুপুর হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতিতে রাখা হল বোঝা যাচ্ছে না। ভোটে জিতেও আমাদের কেন কাজের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না, তা নিয়ে জেলাশাসকের কাছে লিখিত ভাবে জানতে চাইব।”

একই কথা বলছেন বাঁকুড়ার কংগ্রেস বিধায়ক শম্পা দরিপাও। তিনি বলেন, “প্রশাসনিক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ হচ্ছে। তৃণমূল কোনও নিয়মের তোয়াক্কাই করছে না।” যদিও বাঁকুড়া মেডিক্যালের রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যানের পদ পাওয়া মিনতিদেবী বলছেন, “রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী আমাকে কাজের সুযোগ দিয়েছেন। ভাল ভাবে সেই কাজ করতে চাই। বিরোধীরা কী বলল তা আমি কানে তুলতে চাই না।”

জেলা পরিষদের সভাধিপতি তথা তৃণমূলের জেলা নেতা অরূপ চক্রবর্তী বলেন, “বাঁকুড়া ও বিষ্ণুপুর দু’টি আলাদা স্বাস্থ্য জেলা। শ্যামবাবু ও মিনতিদেবীর বিধায়ক হিসেবে কাজের পূর্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাই তাঁদের দু’টি হাসপাতালের উন্নয়নের কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে কারও কোনও ক্ষোভ থাকা ঠিক নয়।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Medical college chairman Mamata Banerjee
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE