Advertisement
১০ মে ২০২৪

গানেই লোকশিক্ষা দেন নানুরের গণপতি

নানুরের বামুনডিহি গ্রামে প্রান্তিক চাষি পরিবারে জন্ম গণপতিবাবুর। তিন মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে সংসার। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে দীর্ঘ দিন আগে। জমির যৎসামান্য আয়, মাসিক হাজার টাকা শিল্পী ভাতা আর অন্যের দোকানে খাতা লিখে কোনও রকমে তাঁর সংসার চলে যায়।

মগ্ন: লিখছেন গণপতি ঘোষ। নিজস্ব চিত্র

মগ্ন: লিখছেন গণপতি ঘোষ। নিজস্ব চিত্র

অর্ঘ্য ঘোষ
নানুর শেষ আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০১৭ ০১:০৮
Share: Save:

জ্ঞান হওয়ার আগেই বাবাকে হারিয়েছিলেন। তারপর ছেলে বয়সেই পেটের দায়ে নাম লিখিয়েছিলেন লোকগানের দলে। সেই দলের প্রয়োজনেই গান লেখা শুরু করেন। তারপর সেই গান লেখাই নেশা হয়ে ওঠে। আজও ৭৫ বছর বয়েসে সেই গানই লিখে চলেছেন গণপতি ঘোষ।

নানুরের বামুনডিহি গ্রামে প্রান্তিক চাষি পরিবারে জন্ম গণপতিবাবুর। তিন মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে সংসার। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে দীর্ঘ দিন আগে। জমির যৎসামান্য আয়, মাসিক হাজার টাকা শিল্পী ভাতা আর অন্যের দোকানে খাতা লিখে কোনও রকমে তাঁর সংসার চলে যায়। কিন্তু, এক সময় বহু কষ্টের দিন পার করে আসতে হয়েছে তাঁকে। জন্মের মাত্র আড়াই মাস বয়সে বাবা মারা যান। অর্থাভাবে দশম শ্রেণির পর ‘ফিজ দাখিলের’ টাকার অভাবে আর পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। তারপর একটু জ্ঞান হতেই নাম লেখান গ্রামের বোলান গানের দলে। দলের প্রয়োজনে গান লেখার তাগিদ অনুভব করেন।

সেই সময় গান লিখিয়ে হিসেবে পরিচিতি ছিল স্থানীয় লোককবি প্রয়াত অহিভূষণ মণ্ডলের। তাঁর কাছেই শুরু হয় গণপতিবাবুর হাতেখড়ি। তারপর থেকে লিখেই চলেছেন একের পর এক বোলান, বাউল, ভাদু, ঝাঁপান, পাঁচলি গান। এ পর্যন্ত লিখে ফেলেছেন পাঁচ হাজারেরও বেশি গান। শুধু বীরভূম নয়, তাঁর লেখা গান নিতে ভিড় জমান বর্ধমান, মুর্শিদাবাদেরও বিভিন্ন লোকগানের দল। বর্ধমানের মাসুন্দির বোলান শিল্পী তরুণ সিংহ, মুর্শিদাবাদের পাঁচথুপির বাউলশিল্পী সাক্ষীগোপাল মালাকার, লাভপুরের ভাদুগানের শিল্পী নাড়ুগোপাল মুখোপাধ্যায়রা জানান, গান অনেকেই লেখেন। কিন্তু, গণপতিদার লেখা না হলে গান ঠিক জমে না। তাঁদের কথায়, ‘‘আমরা মূলত ওঁনার লেখা গানই পরিবেশন করি।’’

নিছক বিনোদন নয়। গানের মাধ্যমেই গণপতিবাবু তুলে ধরেন সমাজ সচেতনা মূলক বিভিন্ন বিষয়। বাবা-মাকে অবজ্ঞা, স্বাক্ষরতা অভিযান, পণপ্রথা, পরিবার পরিকল্পনা থেকে শুরু করে হাল আমলের কন্যাশ্রী, সবুজসাথী প্রকল্পের কথা। কখনও লিখেছেন, ‘বিদ্যালয়ে গিয়ে লেখাপড়া করলি অনেক, আসল বিদ্যা শিখলি না/ তাই তো বলি দানব হয়েই রইলি রে তুই/ মানব হলি না/ বাড়িতে তোর বুড়ো বাপ-মায়ের হলো না ঠাঁই/ তোরও জায়গা হবে নাকো জেনে রাখিস/ কোন ভুল নাই।’ আবার কখনও তার গানে ফুটে উঠে বাল্যবিবাহের কুফল। নিজেই দেন তার সুর। ‘মেয়ের বয়েস আঠারো আর ছেলের বয়েস একুশ ভোলামন ভুলে যেও না/ তার আগেতে বিয়ের তাদের যোগাড়যন্ত কর না/ শ্রীঘরেতে হবে রে ঠাঁই, ছাড়ান পাবা না/ তাই তো বলি বুঝে সুঝে চল তুমি, কাঁচা আলে পা দিও না।’

গান রচনার জন্য ইতিমধ্যেই তাঁকে সংবর্ধনা জানিয়েছে লাভপুরের বীরভূম সংস্কৃতি বাহিনী, কীর্ণাহার তরুণ সমিতি, নানুর চণ্ডীদাস পাঠাগার, নানুরের মহুয়া পত্রিকা গোষ্ঠী, নানুরের শ্রীপাঠ উৎসব কমিটির মতো বেশ কিছু সংস্থা। তাদের মধ্যে বীরভূম সংস্কৃতি বাহিনীর উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায়, মহুয়া পত্রিকা গোষ্ঠীর রঘুরাজ সিংহরা বলেন, ‘‘গণপতিবাবুর গানে মাটির গন্ধের সঙ্গে মিশে আছে লোকশিক্ষার আলো।’’ কী ভাবে আসে গান? গণপতিবাবু বলেন, ‘‘মানুষের ভালবাসাই আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নেয় ওই সব গান।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE