জমি রেজিস্ট্রির কাজে বাথানিয়া গ্রাম থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে ইন্দাসের সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে আসেন শেখ গোলাম জিগরিয়া। আর দফতরে এসে তাঁকে বারবার ফিরে যেতে হয়। কাজ হয় না।
একই ভাবে পাত্রসার থানার আলিপুর গ্রামের রহিম তলবদার প্রায় ২৫ কিলোমিটার পথ ট্রেনে সওয়ার হয়ে ইন্দাসের সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে আসেন। তিনিও জমি রেজিস্ট্রি করাতে চান। কিন্তু, বারবার এসেও কাজ না হওয়ায় শুকনো মুখে তাঁকেও বাড়ি ফিরে যেতে হয়েছে।
ইন্দাসের কুশমুড়ি গ্রামের শ্রীকান্ত বোড়ারও কাজ আটকে রয়েছে গোলাম, রহিমদের মতো। শ্রীকান্তবাবুর আক্ষেপ, ‘‘জমি রেজিস্ট্রি করাতে এই দফতরে আসা-যাওয়া করে করে আমার জুতোর শুকতলা ক্ষয়ে গেল। অথচ কাজটাই হল না!’’
এক-দুই দিন নয়। টানা ২২ দিন ইন্দাসের সাব-রেজিস্ট্রি অফিস অচল হয়ে রয়েছে। শেখ গোলাম নিজের জমি বিক্রি করেছেন, রহিম ও শ্রীকান্তবাবুরা নতুন জমি কিনেছেন। কিন্তু, রেজিস্ট্রেশন না হওয়াতে জমির হাত বদল মাঝপথে আটকে রয়েছে। শ্রীকান্তবাবুদের মতো কয়েকশো মানুষের কাজ আটকে রয়েছে। মাথায় হাত দলিল লেখকদের।
কিন্তু সমস্যাটা কোথায়?
যে বেসরকারি মোবাইল সংস্থার ইন্টারনেট সংযোগের উপর ভিত্তি করে গোটা বাঁকুড়া জেলার রেজিস্ট্রি দফতর দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার ‘লিঙ্ক ফেল’। শুধু ইন্দাসই নয়, এই সমস্যায় কম বেশি ভুগছে জেলার প্রায় সব সাব-রেজিস্ট্রি অফিসই। শালতোড়া ব্লকের সাব-রেজিস্ট্রি অফিসেও গত ১৫ দিন ধরে একই সমস্যার জেরে যাবতীয় কাজ বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে। মাস খানেক আগে এই সমস্যার জন্য গঙ্গাজলঘাটি ব্লকের সাব-রেজিস্ট্রি দফতরও মাস খানেকের মতো অচল হয়ে পড়ে ছিল। ‘লিঙ্ক ফেল’-এর জেরে চলতি অর্থবর্ষের শুরুতেই কোটি টাকার বেশি রাজস্ব ঘাটতির মুখে পড়েছে জেলা রেজিস্ট্রি দফতর। ইন্দাসের দলিল লেখক তথা পশ্চিমবঙ্গ দলিল লেখক সমিতির জেলা কমিটির সদস্য সৈয়দ আনিসুর রহমানের ক্ষোভ, “২০ বছর ধরে এই পেশার সঙ্গে যুক্ত আমি। অথচ কোনও দিনই এ ভাবে গোটা দফতরকে অচল হতে দেখিনি। সাধারণ মানুষ দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসছেন, আর ফিরে যাচ্ছেন। দেখে নিজেদেরই খারাপ লাগছে। একই সঙ্গে রোজগারে কোপ পড়েছে আমাদেরও।’’ দলিল লেখক সংগঠনের ইন্দাস শাখার সম্পাদক বিশ্বনাথ ভট্টাচার্য বলেন, “সরকারি আয়ের একটা স্তম্ভ হল এই সাব রেজিস্ট্রি দফতর। অথচ দিনের পর দিন দফতরে কোনও কাজ হচ্ছে না। প্রশাসনিক ভাবে দ্রুত সমস্যা মিটিয়ে ফেলার কোনও উদ্যোগও চোখে পড়ছে না।’’
উল্লেখ্য, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকেই সাব-রেজিস্ট্রি দফতরের যাবতীয় কাজ হচ্ছে অনলাইনে। জমির ভ্যালুয়েশন, দলিল জমা নেওয়া থেকে খুঁটিনাটি তথ্য— সবই সরাসরি ইন্টারনেটের মাধ্যমে রেজিস্ট্রি দফতরের নিজস্ব ওয়েবসাইটে ‘স্টোর’ করার প্রক্রিয়া চালু হয়েছে। এই পুরো প্রক্রিয়ার জন্য একটি বেসরকারি মোবাইল সংস্থার ‘ব্রডব্যান্ড’ পরিষেবা ব্যবহার করছে এই দফতর। তবে, এপ্রিল থেকেই জেলা জুড়ে শুরু হয়েছে ইন্টারনেটের ‘লিঙ্ক ফেল’-এর সমস্যা। জেলার কমবেশি সব ক’টি ব্লকেই এই ঘটনায় অফিসগুলিতে কাজ ব্যাহত হচ্ছে। প্রভাব পড়ছে সরকারের রাজস্ব আদায়েও। দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, গত ২০১৪-১৫ অর্থবর্ষে জুলাই মাস পর্যন্ত গোটা জেলায় রাজস্ব আদায় হয়েছিল প্রায় ১৮ কোটি ৩৪ লক্ষ ৯৪ হাজার টাকা। সেবার নতুন দলিল হয়েছিল ১১ হাজার ৯১৫টি। চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবর্ষে জুলাই পর্যন্ত প্রায় ১ কোটি টাকা কমে রাজস্ব দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৭ কোটি ১৬ লক্ষ ১১ হাজারে। দলিল সংখ্যাও গতবারের তুলনায় কমে গিয়েছে। চলতি অর্থবর্ষে জুলাই মাস পর্যন্ত দলিল হয়েছে ১০ হাজার ৩১৩টি। টানা লিঙ্ক ফেলের সমস্যায় ভুগতে থাকা ইন্দাস ও শালতোড়া ব্লকেও গত অর্থবর্ষের তুলনায় চলতি অর্থবর্ষে ব্যপক হারে দলিল সংখ্যা ও রাজস্ব কমে গিয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে রেজিস্ট্রি দফতর কী পদক্ষপে করছে, জানতে চাওয়া হলে জেলা সাব রেজিস্ট্রি দফতরের আধিকারিক সাধন সরকার জানান, রাজ্যকে সমস্যার কথা জানানো হয়েছে। বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়ার জন্যও আবেদন জানানো হয়েছে। ডেপুটি ইনস্পেক্টর জেনারেল অফ রেজিস্ট্রেশন শান্তিরায় চৌধুরী এই সমস্যার কথা মেনে নিচ্ছেন। বাঁকুড়া জেলার সমস্যার রিপোর্টও পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন তিনি। তাঁর কথায়, “রাজ্যের নানা জায়গাতেই লিঙ্ক ফেলের একটা সমস্যা হচ্ছে। মাস খানেক আগে সমস্যাটা আরও বেশি হচ্ছিল। এখন কিছুটা কমলেও অস্থায়ী ভাবে কিছু ব্লকে সমস্যা আছে।’’
শান্তিরায়বাবু জানান, ওই বেসরকারি মোবাইল সংস্থাকে সমস্যার সমাধানের জন্য বলা হয়েছে। এ ছাড়া আরও একটি সংস্থার ইন্টারনেট সংযোগ বিকল্প হিসেবে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তিনি বলেন, “বিকল্প ইন্টারনেট সংযোগ রাখার কারণ, একটি খারাপ হলে যাতে অন্যটি দিয়ে কাজ চালানো যায়।’’ এতে দফতরের সমস্যা মিটবে বলেই আশাবাদী তিনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy