মাওবাদী নাশকতার পরে আর শ্রী ফেরেনি দুয়ারসিনি বাংলোর।
মাওবাদী নাশকতার ট্রমা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে চাইছেন বান্দোয়ানবাসী। কিন্তু বান্দোয়ানের অপার সৌন্দর্যকে পর্যটকদের কাছে তুলে ধরতে সরকার কি ততটা এগিয়েছে? এই প্রশ্ন বাসিন্দাদের।
কারণ দুয়ারসিনির বনবাংলো মাওবাদীরা পুড়িয়ে দেওয়ার পরে আর তা পুনর্নিমাণ করা হয়নি। এ ছাড়া ছোটখালো পাহাড়ি টিলা আর জঙ্গলে ঘেরা এই ব্লকের আরও কয়েকটি জায়গা পর্যটকদের আকর্ষিত করে। কিন্তু সে সব নিয়েই বা সরকারের উদ্যোগ কোথায়? বাসিন্দাদের অভিযোগ, অযোধ্যাপাহাড় নিয়ে জেলা প্রশাসন বা সরকার কিছুটা উদ্যোগী হলেও বান্দোয়ান যেন দুয়োরানি হয়ে রয়েছে।
ঝাড়খণ্ড ঘেঁষা বান্দোয়ানের জঙ্গল ও পাহাড়ের সৌন্দর্যে পর্যটকেরা মুগ্ধ হন। এক সময়ে বান্দোয়ানে পর্যটকদের আনাগোনা বাড়লে মাওবাদী নাশকতা নিয়ে বাড়াবাড়ি হওয়ার পরে তাতে ভাটা পড়ে। কিন্তু দিন বদলের পরে বান্দোয়ানের পুরনো ঐতিহ্য ফেরাতে সরকার সে ভাবে উদ্যোগী হয়নি।
অথচ এমনটা হওয়ার কথা নয়। বান্দোয়ানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে মূলধন করে এলাকায় পর্যটক টানতে বামফ্রন্ট আমলে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গ বন উন্নয়ন নিগমের আর্থিক বরাদ্দে ঝাড়খণ্ড সীমানায় দুয়ারসিনিতে ২০০১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি তিনটি বনবাংলো তৈরি করা হয়। সেই সময় দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাসীবালা সহিস বনবাংলো উদ্বোধন করে জানিয়েছিলেন, বান্দোয়ানের প্রাকৃতিক সম্ভারকে কেন্দ্র করে আরও কয়েকটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
বন উন্নয়ন নিগম সূত্রে জানা যায়, চালু হওয়ার পর থেকেই দুয়ারসিনির বাংলোগুলিতে পর্যটকের ভিড় লেগেই থাকত। কলকাতায় বন উন্নয়ন নিগমের অফিস থেকে বুকিং হতো। অনেকসময় দেখা গিয়েছে, তিনমাস আগেও বাংলো বুক করা যেত না। বাংলোয় কমোড, গিজার থেকে আধুনীক স্বাচ্ছন্দ্যের যাবতীয় ব্যবসা ছিল। আলো জ্বালাত জেনারেটর। পর্যটকরা চাইলে জ্যোৎস্না রাতে সেখানে আদিবাসীদের নাচের আসরও বসত। রাঁধুনিকে পয়সা দিলে গরম ভাতের সঙ্গে বুনো মুরগির মাংস মিলত। আবার যারা শহরের কোলাহলকে দূরে সরিয়ে দুদিনের জন্য শান্ত নিরিবিলি সময় কাটাতে চাইতেন, তাঁরা সাতগুড়ুম নদীর পাড়ে বসে প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে যেতেন। ২০০৯ সালে এক রাতে মাওবাদী নাশকতায় তিনটি বনবাংলো পুড়ে যায়। সেই থেকে এখনও পর্যন্ত বনবাংলো পুননির্মাণের কাজ শুরু হয়নি। সেই সময় পর্যটক আনাগোনায় গাড়িভাড়া থেকে বাংলোয় রান্না করা, নাচ-গান করেও স্থানীয়রা রোজগার করতেন। বান্দোয়ান বাজার থেকে ১৫ কিমি দূরের দুয়ারসিনিতে এখনও পর্যটকের দল বিচ্ছিন ভাবে আসেন। কিন্তু থাকার ব্যবস্থা না থাকায় হতাশা নিয়েই তাঁরা ফিরে যান।
রয়েছে সাতগুড়ুম নদী। আদতে পাহাড়ি খাল। জঙ্গলকে সাতবার পাক দেওয়ার জন্য নাম হয়েছে সাতগুড়ুম। এমনিতে সাধারণ খাল। কিন্তু বৃষ্টিতে পাহাড়ের ঢাল গড়িয়ে নেমে আসা জলে ফুলে উঠে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে সাতগুড়পম। সম্প্রতি সাতগুড়ুম নদীর ওপর সেতু নির্মিত হয়েছে। এখান থেকে আসনপানি, পচাপানি গ্রাম পেরিয়ে লাইকা পাহাড়ে চড়া যায়। বিশাল উঁচু পাহাড় গভীর জঙ্গলে ঘেরা। যাঁরা একটু সাহসী তাঁরা পাহাড়ে চড়ার মজা নিতে পারেন। ময়ূরঝর্ণা গ্রাম পেরোলে ওপাশে ঝাড়খণ্ডের ঘাটশিলা থানা। এখানে হাতিদের অবাধ বিচরণ। তবে জঙ্গলে আলাদা করে বান্দোয়ান এবং ঘাটশিলার সীমানা বোঝা মুশকিল।
টটকো নদীর উপর যমুনা সেতু সংলগ্ন এলাকা সাজানো শুরু হলেও কাজ অনেক বাকি।
আর্কষণ আরও রয়েছে। বান্দোয়ান বাজার থেকে পাঁচ কিমি দূরে পলিটেকনিক কলেজের রাস্তা ধরে রয়েছে করালি পাহাড়। উঁচু পাহাড়ের মাথায় গুহার মধ্যে রয়েছে কালীমন্দির। পাহাড়ের মাথায় উঠলে পুরো বান্দোয়ান দেখা যায়— দূরে শীর্ণকায় নদী, মাঝখানে এক টুকরো বান্দোয়ান বাজার। চারপাশে টিলা ও সবুজ জঙ্গল। অসাধারণ দৃশ্য। পাহাড়ে চড়ার পাথরের ধাপ করে সিঁড়ি বানানো রয়েছে। সংস্কারের অভাবে কোথাও কোথাও ভেঙে পড়েছে।
বান্দোয়ানের গুরুড় পঞ্চায়েত এলাকার কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দাদের বারোমাস জলাধারের জল ডিঙিয়ে আসতে হয়। জল বেড়ে গেলে নৌকা বা ডিঙিই ভরসা। এখানে টটকো নদীকে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। জলাঘারটি পারগেলা নামে পরিচিত। জলাধারের পাড় ঘিরে অনেকখানি রাস্তা হেঁটে যাওয়া যায়। পারগেলা জলাধারে বোটিংয়ের ব্যবস্থা করার দাবি বাসিন্দাদের। কুইলাপাল বান্দোয়ানের আর একটি বাজার। গভীর জঙ্গলের জন্য কুইলাপালের আলাদা পরিচিতি রয়েছে। তবে কয়েক দশকে জঙ্গল অনেকখানি পাতলা হয়ে গিয়েছে। বান্দোয়ান বাজার থেকে কুইলাপাল বাজারের দূরত্ব ১৮ কিমি। কুইলাপাল ঢোকার আগে টটকো নদীর উপর একটি সেতু আছে। ধনুকের আকৃতি এই সেতু যমুনা সেতু নামে পরিচিত। পাশেই ফুলের বাগান। পৌষ সংক্রান্তি ও ভাদু উৎসবের সময় সেতুর নীচে মেলা বসে।
কিছু কিছু চিত্র পরিচালক বান্দোয়ানের প্রকৃতির এই অনুপম বাহারের খোঁজ পেয়ে এখানে শ্যুটিং করেছেন। মিঠুন চক্রবর্তীর মতো বড় মাপের অভিনেতাও শ্যুটিং করতে এসে এখানকার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন— বান্দোয়ানে এত ভাল লোকেশন রয়েছে, আগে জানতাম না। বাসিন্দাদের মতে, তৃণমূল রাজ্য সরকারের সঙ্গে টালিগঞ্জের সম্পর্ক ভাল। সরকার তাঁদের উৎসাহ দিলে শ্যুটিংয়ের লোকেদের আনাগোনা বাড়ত। বাসিন্দাদের আরও দাবি, বান্দোয়ানের পর্যটনকেন্দ্রগুলি সংস্কার করে এবং নতুন করে কয়েকটি বাংলো নির্মাণ করে ভাল করে প্রচার করা দরকার। যেমন অযোধ্যা উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে, তেমনই বড়দিনের ছুটির সময়ে বান্দোয়ান উৎসবও করা যেতে পারে।
কী বলছেন প্রশাসনের আধিকারিক ও জনপ্রতিনিধিরা? বান্দোয়ানের বিডিও মধুসূদন মণ্ডলও স্বীকার করেছেন, ‘‘সন্দেহ নেই দুয়ারসিনি বনবাংলো পুননির্মাণ করা হলে পর্যটকদের আনাগোনা বাড়ত। তবে পঞ্চায়েত সমিতি থেকে এ রকম বনবাংলো নির্মাণ করা যায় কি না তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা হচ্ছে।’’
বান্দোয়ানের সিপিএম বিধায়ক সুশান্ত বেসরা বলেন, ‘‘কয়েক মাস আগে আমি পর্যটন মন্ত্রী ব্রাত্য বসুকে বিধানসভায় দুয়ারসিনি বাংলো সংস্কার িনয়ে সরকার কী ভাবছে জানতে চেয়েছিলাম। তাতে পর্যনটন মন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু কবে সেই কাজ শুরু হবে তিনি সুনির্দিষ্ট ভাবে তা জানাননি।’’ তাঁর আক্ষেপ, বাম সরকার জঙ্গলমহলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তুলে ধরতে উদ্যোগী হলেও তৃণমূল সরকারের কোনও হেলদোল নেই। যদিও তা মানতে নারাজ পুরুলিয়ার সভাধিপতি সৃষ্টিধর মাহাতো। তাঁর দাবি, ‘‘অযোধ্যা পাহাড়কে আমরা পুরুলিয়ার পর্যটনের মুখ করেছি। পাশাপাশি জেলার অন্যান্য পর্যটনকেন্দ্রগুলিকে একে একে তুলে আনার চেষ্টা হচ্ছে। বান্দোয়ানও সেই তালিকায় রয়েছে।’’
বিধায়ক সুশান্তবাবুর আক্ষেপ, ‘‘বান্দোয়ানকে জেলার আর পাঁচটা দ্রষ্টব্যস্থানের সঙ্গে এক পঙ্ক্তিতে ফেলে দেওয়া ঠিক নয়। মাওবাদী নাশকতায় বান্দোয়ান ও অযোধ্যার পর্যটন সমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাহলে দিনবদলের পরে অযোধ্যা এখন অগ্রাধিকার পেলে বান্দোয়ান কেন উপেক্ষিত থাকবে? বিধায়ক কোন দলেরই এটাই কি উন্নয়নের মাপকাঠি?’’
ছবি: সমীর দত্ত ও প্রদীপ মাহাতো।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy