শব্দ করে থেমে গেল বাসটা। চার দিকে ধূ ধূ ফাঁকা মাঠ।
কি হল?
— বাকিটা হেঁটেই যেতে হবে।
কেন?
‘সামনের রাস্তা খুব সরু। বাস ঢুকবে না’— আঙুল উঁচিয়ে পথটা দেখিয়ে যেন আদেশের সুর বাস চালকের গলায়। তখন সাড়ে তিনটে। মাথার উপরে আগুনে রোদ নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে আছি নানুরে!
বোমা-গুলির লড়াইয়ে তেতে থাকা নানুরে ভোট করতে যেতে হবে শুনে আপত্তি উঠেছিল বাড়িতে। কোনও রকমে বুঝিয়ে, বারে বারে ফোনে যোগাযোগ রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ছাড় মিলেছিল। ব্যাগ গোছাতে গোছাতে বলেছিলাম, প্রথম ভোট করাতে যাচ্ছি নাকি? কিচ্ছু হবে না।
মিথ্যে বলব না, একটু দুঃশ্চিন্তা যে আমরাও হয়নি, তা নয়। ভাবছিলাম, শেষমেষ নানুরের সাওতা গ্রামে দায়িত্ব পড়ল। একে কপাল ছা়ড়া আর কী-ই বা বলব? তবু বুক ঠুকে বেরিয়ে পড়েছিলাম। যে অবস্থাতেই পড়ি না কেন কর্তব্যে গাফিলতি করব না। এই সিদ্ধান্তটা নিয়েই নিয়েছিলাম।
বাসে সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে চলেছি। তখনই একটা জায়গায় বলা নেই, কওয়া নেই থেমে গেল বাস। অচেনা জায়গায় ফাঁকা মাঠের মধ্যে তখন এক জন মাইক্রো অবজার্ভার-সহ আমরা ন’জন কর্মী। দেড় কিলোমিটার হেঁটে যেতে হবে শুনে শিরদাঁড়া দিয়ে যেন ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। আশ্চর্যের ব্যাপার তখনও পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে কোনও ফোর্স নেই। পথে আসতে আসতে দেখা মেলেনি আধা সেনারও।
অগত্যা, আর কী করা। আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। গ্রামের ঢালাই রাস্তা ধরে চলেছি। পিঠে ব্যাগ। নজর সামনে। দর দর করে ঘামছি। বুঝতে পারছি দু’একজন পথ চলতি মানুষ জন আমাদের দিকে নজর রাখছে। এর-ওর কাছে শুনে শুনে সাঁওতা কিরণশশী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পৌঁছলাম। কেন্দ্রে পৌঁছে দেখলাম স্কুলে চার জন কেন্দ্রীয় বাহিনী চলে এসেছেন। রয়েছেন রাজ্য পুলিশের দু’জন কর্মীও। এ বার বুকে বল এল।
কিন্তু বুথের হাল দেখে মনে হল ৬৬৭ জন ভোটারের ভোট নিতে গেলে গোপনীয়তা বজায় থাকবে না। ইভিএম যেখানেই রাখি না কেন, উঁকিঝুঁকি মারার যথেষ্ট জায়গা থাকবে। বুথ পরিবর্তন করার জন্য সংশ্লিষ্ট সেক্টর অফিসার-সহ নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করি। কাজ হয় তাতে।
কিছু সময় পরে রাজনৈতিক দলগুলির তরফে কয়েক জন দেখা করে যান। তাঁদের থেকেই জানতে পারি, শাসকদল ছাড়া অন্য কোনও দলের এজেন্ট না-ও থাকতে পারে। যাই হোক, আগন্তুকদের সকাল ছ’টার মধ্যে মক পোলিং শুরু করার কথা বলি। রাতের দিকে এলাকার স্ব-নির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের রান্না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।
ভোরে উঠে স্নান সেরে সকাল ছ’টায় এক জন মাত্র এজেন্টের উপস্থিতিতে মক পোলিং শুরু করি। সাতটা বাজতেই শুরু হয় ভোট। নাঃ তখনও পর্যন্ত কোনও গোলমালের খবর নেই। বেশ উৎসাহেই ভোট হচ্ছে। মনে মনে বললাম, এমনটাই যেন হয়। দেখলাম, মহিলাদের মধ্যে ভোট দেওয়ার মধ্যে উৎসাহ। বুথের বাইরে চার জওয়ান তাঁদের কাজ করছে। তৎপর রয়েছে পুলিশও। দুপুর বারোটার মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশের উপরে পোলিং হয়ে যায়। নির্ধারিত সময় ছ’টার মধ্যে
৬৬৭ জন ভোটারের মধ্যে ৫৪৮ জন ভোট দেন। তবে বিরোধীদের
কোনও এজেন্ট ছিল না। তবুও অনিয়ম হয়নি।
দিনের শেষে মনে হল কেন এত আশঙ্কা করেছিলাম। এমনটাই তো আমরা চাই। এই নানুরই তো চণ্ডীদাসের নানুর! প্রেমের নানুর। সেখানে হিংসার স্থান কোথায়?
(সহকারি শিক্ষক, রামপুরহাট স্কুল)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy