Advertisement
০৪ মে ২০২৪

থেমে গেল সলাবতের ঝুমুর

ঝুমুরকে ভালবেসে ঘর ছেড়েছিলেন। ঝুমুরকে নিয়েই গ্রামের প্রান্তে নদীর পাশে বেঁধেছিলেন ছোট চালাঘর। এ বার সেই ঝুমুরকে ছেড়েই চলে গেলেন সলাবত।

সমীর দত্ত
বরাবাজার শেষ আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০১৬ ০২:১৪
Share: Save:

ঝুমুরকে ভালবেসে ঘর ছেড়েছিলেন। ঝুমুরকে নিয়েই গ্রামের প্রান্তে নদীর পাশে বেঁধেছিলেন ছোট চালাঘর। এ বার সেই ঝুমুরকে ছেড়েই চলে গেলেন সলাবত।

বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে বাড়িতে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন প্রখ্যাত ঝুমুর শিল্পী সলাবত মাহাতো। সেই সঙ্গে শেষ হল লোকশিল্পের একটা অধ্যায়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়েস হয়েছিল ৭৪ বছর। রেখে গেলেন স্ত্রী আতুবালাদেবী, তিন ছেলে, দুই মেয়ে ও নাতি-নাতনি ও অগণিত গুণমুগ্ধদের।

পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, বয়েস জনিত নানা সমস্যায় এই শিল্পী ভুগছিলেন। বৃহস্পতিবার রাতে তিনি হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হওয়ার পরে তাঁকে বরাবাজার ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু চিকিৎসকদের তিনি কোনও সুযোগ দেননি।

তাঁর প্রয়াণের খবর এ দিন সকালে রাঢ়বঙ্গের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। লোকশিল্প সম্পর্কে ওয়াকিবহালরা জানাচ্ছেন, ঝুমুরগানের নৃত্যশিল্পী সিন্ধুবালাদেবীর পর পুরুলিয়ায় এত বড় মাপের শিল্পীর প্রয়াণে লোক সঙ্গীত শিল্পে একটা অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। জেলার অন্যতম লোক গবেষক ক্ষীরোদচন্দ্র মাহাতোর কথায়, ‘‘সিন্ধুবালাদেবী ঝুমুর নাচে পুরুলিয়ার নাম উজ্বল করেছিলেন। তেমনই সলাবতবাবু দীর্ঘকাল ধরে ঝুমুর গান পরিবেশনের মাধ্যমে পুরুলিয়ার পরিচিতি বাড়িয়েছিলেন। ঝুমুর গানের তিনি শৈল্পিক উত্তরণ ঘটিয়েছিলেন। জেলার লোক সঙ্গীত শিল্পের এই শূন্যতা বোধহয় পূরণ হবে না।’’

একনজরে

• জন্ম ১৯৪২ সাল।

• ৯ বছর বয়স থেকে গানবাজনায় তালিম।

• নিজেই ঝুমুর গান লিখে, সুর দিয়ে গাইতেন।

• ১৯৯৬ সালে আব্বাসউদ্দিন আহমেদ স্মৃতি পুরস্কার এবং চামু পুরস্কার।

• ১৯৯৭ সালে লালন স্মৃতি পুরস্কার।

• লোকশিল্পীদের মতে, ঝুমুর নৃত্যশিল্পী সিন্ধুবালাদেবীর পরে আরও এক নক্ষত্রচ্যুত হল।

ঝুমুর গানের গায়করা প্রচলিত গান অথবা অন্য গীতিকারের লেখা গান আসরে পরিবেশন করে থাকেন। কিন্তু সলাবতবাবু প্রচলিত গান গাওয়া ছাড়াও ঝুমুর গান লিখে তাতে সুর দিয়ে গাইতে পারতেন। আর্থিক অনটনের জন্য স্কুলের পড়া বেশিদিন চালাতে পারেননি। মূলত দরবারি ঝুমুর গানের জন্যই তিনি বিখ্যাত ছিলেন। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে রাত জেগে ঝুমুর গানের ডালি পরিবেশন করেছেন তিন। তিনি বাউল সঙ্গীতও গাইতেন। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে এই লোক সঙ্গীত শিল্পীকে ‘লালন’ সম্মানে ভূষিত করা হয়। এ ছাড়াও বিভিন্ন জেলা ও ভিন্‌ রাজ্যের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শিল্পীকে সম্মানিত করা হয়েছে।

মানবাজার ২ ব্লকের শিল্পী হংসেশ্বর মাহাতো, কেন্দা থানার রাজনোয়াগড়ের রাজপরিবারের সদস্য শিল্পী মিহিরলাল সিংহদেওরা বলেন, ‘‘সলাবতবাবুর চমৎকার গানের গলা ছিল। একাধারে গীতিকার, সুরকার এবং গায়ক তিনটি গুণের সংমিশ্রণে তাঁর গান শ্রোতার অন্তর ছুঁয়ে যেত। তিনি সুকন্ঠের অধিকারী ছিলেন। তার গলায় ঝুমুর গান একটি বিমূর্ত রূপ পেত।’’

খবর পেয়ে এ দিন শিল্পীর বাড়িতে অনেকেই আসেন। শ্রদ্ধা জানিয়ে যান সভাধিপতি সৃষ্টিধর মাহাতো, সিপিএমের জেলা সম্পাদক মণীন্দ্র গোপ, জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি আধিকারিক মানসী মণ্ডল ও দফতরের কর্মীরা। যাঁরা আসতে পারেননি তাঁরাও এ দিন ঘুরে ফিরে শুধু সলাবতকে ঘিরে নানা স্মৃতির রোমন্থন করে গিয়েছেন।

তাঁদের কাছে শোনা গিয়েছে, বরাবাজার থানার লটপদা গ্রামে তাঁর বাড়ি। চাষি পরিবারের সন্তান। তবে জমিজমা ছিল না। ঝুমুর গানের সাধনার লক্ষ্যে তিনি প্রায় দু’দশক আগে গ্রামের প্রান্তে নদীর ধারে খড়ের চালা নামিয়ে বাস করতে শুরু করেন। আশ্রমিক জীবন শুরু করেছিলেন। এক ছেলে, স্ত্রী ও নাতিকে নিয়ে তিনি সেখানে থাকতেন। সেখানেই তিনি মারা গেলেন।

প্রায় অর্ধশতকের বেশি সময়ের সঙ্গী স্ত্রী আতুবালা কথা বলার মতো অবস্থায় ছিলেন না। কোনও রকমে বলেন, ‘‘যখন দেখলাম মানুষটা সংসারে থেকেও সংসারের টান নেই, সারাদিন গান লিখছেন তাতে সুর দিচ্ছেন বাধা দিইনি। মাসের মধ্যে অর্ধেক দিন গান শোনাতে বাইরে চলে যাচ্ছেন দেখে এই মানুষটাকে আর একা ছাড়া চলবে না বলে ঠিক করি। সেই থেকে তিনি স্বামীর সর্বক্ষণের সঙ্গী।’’

রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় তো বটেই ঝাড়খণ্ড, বিহার প্রভৃতি রাজ্যেও শিল্পী গান গেয়ে এসেছেন। শংসাপত্র, মানপত্রে ঝুলি ভরেছে। কিন্তু পরিবার প্রতিপালনের জন্য স্থায়ী আয় ছিল না। শিল্পী ভাতা হিসাবে প্রতি মাসে এক হাজার টাকা ভাতা হিসেবে পেতেন। এ ছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ঝুমুর গান গেয়ে যেটুকু পেতেন, তা দিয়েই সংসার চালাতেন।

সলাবত মাহাতোর দেহ আঁকড়ে নাতি।—নিজস্ব চিত্র।

ঝুমুর শিল্পকে তিনি ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। জেলার বিভিন্ন এলাকার শিক্ষার্থীরা তাঁর কাছে গান শিখতে আসতেন। তবে বয়েসের ভার তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। ডাক পেলেই বেরিয়ে পড়তেন গান শোনাতে।

সলাবতবাবুর ছোট ছেলে তাপস মাহাতোও গান করেন। বাবার সঙ্গে বহু আসরে তিনি গিয়েছেন। তাপসবাবু বলেন, ‘‘বাবা টাকা-পয়সার ব্যাপারে নিস্পৃহ ছিলেন। অনেক সময় চুক্তির থেকে টাকা কম নিয়েও আসরে গান গেয়ে এসেছেন। মানুষটা ঝুমুর গান ছাড়া আর কিছু বুঝতেন না।’’

অনিয়মিত খাওয়াদাওয়া, রাত জাগা ইত্যাদির ফলে শিল্পীদের প্রাপ্য প্রায় সমস্ত অসুখ তাকে ঘিরে ধরেছিল। ২০০৭ এর ফেব্রুয়ারিতে কঠিন অসুখে আক্রান্ত হয়ে টাটার একটি হাসপাতালে বেশ কিছুদিন ভর্তি ছিলেন।

চলতি বছরের কালীপুজোর সময় থেকে সলাবতবাবু ফের গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। রাজ্যের তথ্য ও সংস্কৃতি অধিকর্তার নির্দেশে পুরুলিয়া সদর হাসপাতালে শিল্পীকে ভর্তি করানো হয়েছিল। কয়েকদিন আগে বাড়ি ফিরে আসেন। কিন্তু আর মঞ্চে উঠতে পারলেন না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE