মাওবাদী নাশকতা বন্ধ। পুরনো ছন্দে ফিরেছে ব্যবসায়িক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত বান্দোয়ান। ছবি: প্রদীপ মাহাতো।
মাওবাদী এলাকা নয়, ব্যবসায়িক কেন্দ্রের পুরনো পরিচিতি ফেরাতে চাইছে বান্দোয়ান।
কাপড়ে মুখ ঢাকা কয়েকজন জঙ্গল থেকে বেরিয়ে বন্দুকের শাসন চালানোর চেষ্টা করেছে গত কয়েকবছর। যখন তখন পথ-বাড়িতে রক্ত ঝরত। দিনের পর দিন বন্ধ। সেইসব দুঃসহ স্মৃতি এখনও অনেকের মনে দগদগ করছে। অনেকে মাওবাদীদের হাতে নিহত নিকট আত্মীয়ের শোক এখনও ভুলতে পারেননি। কিন্তু দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে এখন সবাই চাইছেন এই ‘শান্তি’ আর যেন না ভাঙে। ঝাড়খণ্ড লাগোয়া এই জনপদ আবার পুরনো ব্যবসায়িক কেন্দ্র হিসেবে আগের মতোই সচল থাকতে চাইছে।
কয়েক দশকে অনেক বদলেছে এই বান্দোয়ান। তখন জেলার একপ্রান্তে থাকা এই জনপদ জঙ্গলে ঘেরা ছিল। জেলা সদর থেকে আসতে গেলে নদী পেরোতে হতো। কিন্তু সেতু ছিল না। চলতি কথায়, ‘পুরুলিয়ার আন্দামান’ বলে পরিচিত বান্দোয়ানে চাকরি করতে এলে অনেকের গায়ে যেন জ্বর আসত। ধীরে হলেও ছবিটা ক্রমশ বদলাতে শুরু করেছিল বামফ্রন্ট রাজ্য সরকারের শেষ এক দশকে এখানে উন্নয়নের চাকা গড়াতে শুরু করে। টটকো ও কুমারী নদীর উপর বিভিন্ন জায়গায় একে একে সেতু গড়ে ওঠে, তৈরি হয় রাস্তাও। বাস চলাচল শুরু হয়। ব্যবসা কেন্দ্র হিসেবে জেলায় একটা নিজস্ব জায়গা তৈরি করতে শুরু করে বান্দোয়ান।
কিন্তু ২০০৩ সালের অক্টোবর থেকে সেই উন্নয়নের চাকায় বেড়ি পড়ে। বান্দোয়ান থানার ওসি নীলমাধব দাস মাওবাদী নাশকতার শিকার হলেন। এরপর একে একে সিপিএম নেতা মহেন্দ্র মাহাতো, প্রাক্তন সভাধিপতি রবীন্দ্রনাথ কর সস্ত্রীক খুন হলেন। নিহতের তালিকা ক্রমশ বাড়তে থাকল। অনুন্নয়নের কারণ দেখিয়ে উঠে আসা মাওবাদীদের নাশকতাতেই স্তব্ধ হয়ে গেল জনজীবন। প্রভাব পড়ল চাষ, ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শিক্ষা ক্ষেত্রে।
ব্যবসায়ীদের অভিজ্ঞতা, সে সময়ে আতঙ্কে ভিন্ জেলার ছোট-বড় ব্যবসায়ীরা বান্দোয়ানের সাথে ব্যবসায়িক লেনদেন প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কেউ কেউ দিনের বেলায় কোনও রকমে কাজ সেরে বিকেলের আগে কার্যত পালিয়ে যেতেন। এ ভাবে বান্দোয়ানের ব্যবসা মার খাওয়ায় উন্নয়ন প্রায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাঁরা জানান, আগে জঙ্গল থেকে কুসুম, লাক্ষা, বহড়া, আমলকি, তেঁতুল বাইরের রাজ্যে চালান যেত। সংগ্রহকারী ও ব্যবসাদাররা দু’টো পয়সার মুখ দেখতেন।
বাবুই ঘাসেরও ভাল চাষ হয়। বাবুই ঘাসের দড়িরও চাহিদা রয়েছে। অনেকেই বাবুই ঘাসের চাষ করে সংসার চালান। কিন্তু বনপার্টির (মাওবাদী) ভয়ে জঙ্গলে ঢুকতে তাঁরা ভরসা পেতেন না। নজরদারির অভাবে সেই সময় কাঠের চোরা চালানকারীরা বেপরোয়া জঙ্গল সাফ করে। ফলে জঙ্গল নির্ভর ব্যবসা অনেকটা থমকে গিয়েছিল।
বান্দোয়ান থেকে কলকাতার দূরত্ব অনেক। তুলনায় ৪৫ কিলোমিটার দূরেই জামশেদপুরের মতো বড় শিল্প শহর রয়েছে। সেখান থেকেও কাপড়, ভুষি মালের জিনিস, বৈদ্যুতিন ও কৃষি সরঞ্জাম কিনে নিয়ে আসা হয়। বদলে বান্দোয়ানের টম্যাটো, লাউ, বাঁধাকপি, ফুলকপি, বেগুন ইত্যাদি সব্জি প্রতিদিন গড়ে ৮-১০ ট্রাক ভর্তি হয়ে জামশেদপুরে যায়। বান্দোয়ান ব্যবসায়ী সমিতির অন্যতম মুখপাত্র মহাদেব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘মাওবাদীদের সন্ত্রাসের দিনগুলোতে বান্দোয়ানের ব্যবসা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল ।ব্যবসায়ীরা বাইরে যেতে ভরসা পেতেন না। ভিন্ জেলার ব্যবসায়ীরাও আসা কমিয়ে দিয়েছিলেন। এখন ছবিটা বদলাতে শুরু করেছে। তবে মাঝখানে বেশ কয়েকটা বছর ব্যবসা-বাণিজ্যের বাজার মন্দা থাকায় ধকল কাটাতে সময় লাগবে।’’
শুধু কী অর্থনৈতিক ক্ষতিই হয়েছে? বান্দোয়ানের ভাবমূর্তিরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বান্দোয়ানের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মধুসূদন অগ্রবালের কথায়, ‘‘ব্যবসার কাজে কলকাতা-সহ নানা জায়গায় যেতে হয়। দেখেছি, পুরুলিয়া শহরের নাম কেউ না শুনে থাকলেও বান্দোয়ানের নাম বললে তাঁরা ‘ও তো মাওবাদীদের ঘাঁটি’ বলে উল্লেখ করেন। বান্দোয়ানের বাসিন্দা বলে পরিচয় পেলে অনেকেই অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকান। আমরা এই পরিচয় আর চাই না। বান্দোয়ান অতীতেও ব্যবসায়িক কেন্দ্র হিসাবে পরিচিত ছিল। সেই পুরানো পরিচয়ই আমরা ফেরত চাই।’’
২০০৬ সালে জেলায় প্রথম হিমঘর স্থাপিত হয় এই বান্দোয়ানেই। বান্দোয়ান সাউথ ল্যাম্পস পরিচালিত এই হিমঘর অবশ্য বেশিদিন চালান সম্ভব হয়নি। দু’বছরের মাথায় বিশাল অঙ্কের দেনা নিয়ে হিমঘর এখন তালাবন্দি। ব্যবসায়ীদের মতে, পরিকল্পনার দোষেই হিমঘর চালু রাখা গেল না। সব্জি সংরক্ষণের জন্য বড় জায়গা রাখা হলে ভরাডুবি হতো না।
রাস্তার দুরাবস্থার জন্যও চাষিরা বেকায়দায় পড়েছেন। ব্যবসায়ী সঞ্জয় হালদারের অভিযোগ, জামশেদপুরে যাওয়ার রাস্তা ভেঙেচুরে যাওয়ায় চাষিরা আর সাইকেলে সেখানে সব্জি নিয়ে যেতে পারছেন না। স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে দেওয়ায় তাঁদের লোকসান হচ্ছেন। তবে ঝাড়খণ্ড সরকার ওই রাস্তা সংস্কারের আশ্বাস দিয়েছেন।
শিক্ষাক্ষেত্রেও বান্দোয়ানে বদল এসেছে। কয়েক বছর হল এখানে ডিগ্রি কলেজ চালু হয়েছে। একটি পলিটেকনিক কলেজও রয়েছে। বাজারে কয়েকটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও চালু হয়েছে।
বান্দোয়ানের বিডিও মধুসূদন মণ্ডল বলেন, ‘‘বিভিন্ন গ্রাম থেকে বান্দোয়ান বাজারে আসার পাকা রাস্তা তৈরি হয়ে গিয়েছে। গ্রামে-গ্রামে এখন ছোট গাড়ির যাতায়াত বেড়েছে। কৃষিক্ষেত্র ও ব্যবসায়িক এলাকা হিসেবে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে।’’
দিন বদলের বান্দোয়ান চাইছে, মাওবাদী নাশকতার জেরে বন্ধ হয়ে যাওয়া দক্ষিণবঙ্গ পরিবহণ নিগমের বাস দু’টি ফের বান্দোয়ান থেকে চালানো হোক। কলকাতার সঙ্গে আরও বাস চালানোরও দাবি উঠেছে। তাতে ব্যবসায়িক লেনদেনও বাড়বে। আদ্রা-ঝাড়গ্রাম ভায়া বান্দোয়ান রেলপথের দাবিও রয়েছে। পরিকাঠামোর উন্নয়ন নিয়েই ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে বান্দোয়ান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy