Advertisement
E-Paper

সরকারি খাতায় নাম, পড়া বেসরকারি স্কুলে

নাম লেখানো সরকারের স্কুলে, কিন্তু পড়াশোনা বেসরকারি ছাতায়। খাতায় লেখা নাম ধরে সরকারি স্কুলে আসছে মিড-ডে মিলের বরাদ্দ, জামাকাপড়-বইয়ের টাকা। যাদের সে সব পাওয়ার কথা, তারা কিছু সুবিধা নিচ্ছে, কিছুটা নিচ্ছে না।

অর্ঘ্য ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০১৫ ০১:১১
প্রার্থনা। নানুরের একটি বেসরকারি স্কুলে সোমনাথ মুস্তাফির ছবি।

প্রার্থনা। নানুরের একটি বেসরকারি স্কুলে সোমনাথ মুস্তাফির ছবি।

নাম লেখানো সরকারের স্কুলে, কিন্তু পড়াশোনা বেসরকারি ছাতায়।

খাতায় লেখা নাম ধরে সরকারি স্কুলে আসছে মিড-ডে মিলের বরাদ্দ, জামাকাপড়-বইয়ের টাকা। যাদের সে সব পাওয়ার কথা, তারা কিছু সুবিধা নিচ্ছে, কিছুটা নিচ্ছে না।

‘ভাল ছেলে তৈয়ারি করিলেই পাশের গ্রামের পাঠশালার পণ্ডিতরা জামা-কাপড় বই টাকার লোভ দেখাইয়া ছেলেটিকে ভাঙাইয়া লইয়া যায়।’— তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘কাকপণ্ডিত’ গল্পে ময়ূরেশ্বরের লোকপাড়া স্কুলের বিরুদ্ধে জমিদারের কাছে এই অনুযোগ করেছিলেন তারই আশ্রিত স্থানীয় বেলেড়া বিল্ববাসিনী মন্দিরের পুরোহিত যতীন চাটুজ্জে। এখনও সেই লোভ দেখানোর খেলা চলছে, যদিও ছেলে ভাঙানোর ক্ষমতা সরকারি স্কুলের চলে গিয়েছে।

অভিভাবকদের বড় অংশের অভিযোগ, প্রাথমিক স্কুলগুলিতে পরিকাঠামোর অভাব তো আছেই, বহু জায়গায় যোগ্য শিক্ষকের বদলে বাম-ডান রাজনৈতিক দলের কর্মীরা ঢুকে পড়েছেন। ওই শিক্ষকেরা স্কুলের বদলে দলের কাজে বেশি সময় দেন। মিড-ডে মিল, জনগণনা, ভোটার তালিকা তৈরি, ভোটের ডিউটির মতো নানা কাজ সামাল দিতে গিয়েও শিক্ষকদের অনেক সময় চলে যায়। বহু জায়গায় ছাত্রছাত্রীর অনুপাতে শিক্ষকের সংখ্যাও কম। গ্রাম শিক্ষা কমিটি বা স্কুল পরিচালন সমিতির নামে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ তো আছেই।

এই পরিস্থিতিতে শুধু তুলনায় বিত্তবানেরা নন, বহু নিম্ন আয়ের অভিভাবকও ছেলেমেয়েদের ভর্তি করাচ্ছেন বেসরকারি স্কুলে। তাতে অস্তিত্ব বিপন্ন বহু সরকারি স্কুলের। বরাদ্দ শিক্ষক অনুপাতে পড়ুয়া মিলছে না। অভিভাবক ও বিভিন্ন বেসরকারি স্কুল কর্তৃপক্ষের বড় অংশের দাবি, পরিস্থিতি সামালাতে সরকারি স্কুলের শিক্ষকেরা পড়ুয়াদের বাড়িতে গিয়ে বলে আসছেন, ‘বেসরকারি স্কুলের শংসাপত্রের মূল্য নেই। হাইস্কুলে ভর্তি হতে বা ভবিষ্যতে কর্মজীবনে সমস্যা হবে। ছেলেমেয়েকে যেখানে ইচ্ছা পড়ান কিন্তু ভর্তিটা অন্তত করে রাখুন আমাদের স্কুলে।’ স্কুলব্যাগ, পোশাক, বই-সহ নানা সরকারি সাহায্যের প্রলোভনও দেখানো হচ্ছে।

এর ফলে সরকারি স্কুলে নাম লিখিয়ে বহু অভিভাবক ছেলেমেয়েকে বেসরকারি স্কুলে পড়াচ্ছেন বলে দাবি ময়ূরেশ্বরের লোকপাড়া সবুজকলি বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক জয়ন্ত ভট্টাচার্য কিংবা লাভপুরের ভাস্বতী বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক রবিশঙ্কর মুখোপাধ্যায়দের। বছর পাঁচ আগে চালু হওয়া সবুজকলি বিদ্যাপীঠের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা দু’শোর কাছাকাছি। প্রধান শিক্ষক জানান, এর মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশের বিভিন্ন সরকারি স্কুলে নাম লেখানো রয়েছে। পরীক্ষা কিংবা বাৎসরিক খেলাধুলোর দিনে তারা সেখানে যায়। কিন্তু পড়াশোনা করে তাঁদের স্কুলে। পরে বাইরের কোনও পরীক্ষায় ভাল ফল করলে সরকারি স্কুলের শিক্ষকরা কৃতিত্ব জাহির করেন।

স্থানীয় কেঁউহাটের বাসিন্দা সুজিত মণ্ডলের মেয়ে সম্পূর্ণা এবং ঢেকার বিমান মণ্ডলের ছেলে অরবিন্দ ওই স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। আবার স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়েও তাদের নাম লেখানো আছে। বিমানবাবুর দাবি, তাঁর ছেলে সরকারি স্কুলে যায়ও না, কোন সরকারি সাহায্য নেয়ও না। সুজিতবাবু জানান, পোশাক কেনার জন্য তাঁর মেয়ে প্রাথমিক স্কুল থেকে সম্প্রতি ৪০০ টাকা পেয়েছে। সেই টাকায় বেসরকারি স্কুলের পোশাক করিয়ে দিয়েছেন।

ভাস্বতী বিদ্যাপীঠ এমনিতে বসে সকালে। তাই সেখানে ক্লাস করার পরেও ছাত্রছাত্রীরা প্রাথমিক স্কুলে চলে যেতে পারে। কিন্তু প্রাথমিক স্কুলও খন সকালে বসে, তখন তাঁদের ছেলেমেয়েরা বেসরকারি স্কুলেই যায় বলে অভিভাবক অসিতবরণ সাধু ও মুদাসসের হোসেন জানিয়ে দিয়েছেন। অসিতবাবুর মেয়ে অহনা চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। এর আগে এক বছর তিনি স্থানীয় পার্বতীশঙ্কর স্বাধীনতা সংগ্রামী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মেয়ের নাম নথিভুক্ত করিয়ে রেখেছিলেন। এখনও তা রয়েছে কি না, তা অবশ্য তাঁর জানা নেই। মুদাসসেরের ছেলে তারিকুল ইসলামেরও নাম তোলা রয়েছে স্থানীয় নির্মলশিব প্রাথমিক বুনিয়াদি বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণিতে।

প্রাথমিক স্কুলগুলিতে পড়ুয়াদের মাথা পিছু বিভিন্ন বরাদ্দ আসে। যেমন মিড-ডে মিলের জন্য মাথা পিছু ১০০ গ্রাম চাল এবং ৩ টাকা ৬৯ পয়সা বরাদ্দ। বই ও পোশাকের জন্য বরাদ্দ ৪০০ টাকা। সত্যি যদি ছাত্রছাত্রীরা নিয়মিত সেখানে না যায়, তবে তাদের জন্য আসা টাকা কোথায় যাচ্ছে, তা নিয়েও অনেকের প্রশ্ন রয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে অভিভাবকদের সঙ্গে রফা করে পড়ুয়াদের ভুয়ো হাজিরা দেখিয়ে সরকারি অনুদান আত্মসাৎ করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠছে।

কোটাসুরের বাড়িতে বেসরকারি স্কুল চালান বিজেপির প্রাক্তন জেলা সভাপতি দুধকুমার মণ্ডল। স্কুলেরও কিছু পড়ুয়ার নাম প্রাথমিক স্কুলে তোলা রয়েছে। দুধকুমােরর অভিযোগ, ‘‘শিক্ষকরা প্রাথমিক স্কুলের মান উন্নয়নের বদলে অভিভাবকদের জুজু দেখিয়ে বলছেন, ‘যেখানেই পড়ান, নামটা আমাদের স্কুলে তুলে রাখুন।’ কতটা নীতিভ্রষ্ট হলে এক জন শিক্ষক এমন একটা কথা বলতে পারেন!’’

লোকপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক পার্বতীচরণ কুণ্ডু, পার্বতী শঙ্কর স্বাধীনতা সংগ্রামী প্রথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অসিত দাস এবং নির্মলশিব প্রাথমিক বুনিয়াদি বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা লক্ষী নন্দী দাবি করেন, কাউকে কোনও রকম ভুল বুঝিয়ে তাঁরা বেসরকারি স্কুলের ছেলে ভাঙিয়ে তাঁরা নিজেদের স্কুলে ভর্তি করান না। স্কুলের স্থায়ী ছাত্রছাত্রীদেরই শুধু বরাদ্দ দেওয়া হয়। তছরুপের অভিযোগও ভিত্তিহীন। এ প্রসঙ্গে বীরভূম জেলা প্রাথমিক স্কুল বোর্ডের চেয়ারম্যান রাজা ঘোষ বলেন, ‘‘একই সঙ্গে কোনও ছাত্র সরকারি ও বেসরকারি স্কুলে পড়ছে, এমন কথা আমার অন্তত জানা নেই। প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকেরা ছাত্র টানার জন্য প্রচার চালাচ্ছেন, এমনও শুনিনি। এমন হওয়াটা কাম্যও নয়।’’ যদিও কোনও ছাত্রছাত্রী সরকারি বা বেসরকারি যে কোনও প্রতিষ্ঠানে পড়তে পারে, তাতে আইনি সমস্যা নেই বলে তিনি জানিয়ে দেন। তাঁর আশ্বাস, ‘‘তছরুপের নির্দিষ্ট অভিযোগ এলে অবশ্যই খতিয়ে দেখা হবে।’’

government aided school private schools enlisted students mayureswar school lavpur school
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy