Advertisement
০৩ জুন ২০২৪

ট্রেনের ডাকে ঘরছাড়া, ট্রেনেই বাড়ি

ট্রেন দেখতে তার খুব ভাল লাগত। ‘পথের পাঁচালি’-র অপুর মতই ট্রেনের হুইসল ডাকত বিজয়কে। কিন্তু সেই ডাকে যে ভোম্বল সর্দারে মতো বাড়ি ছাড়া হবে বছর সাতেকের খুদেটি— বাবা-মা তা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি।

বাবা-মায়ের সঙ্গে বিজয়। পুরুলিয়া আদালতের বাইরে। —নিজস্ব চিত্র

বাবা-মায়ের সঙ্গে বিজয়। পুরুলিয়া আদালতের বাইরে। —নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ১৩ মে ২০১৬ ০২:০৫
Share: Save:

ট্রেন দেখতে তার খুব ভাল লাগত। ‘পথের পাঁচালি’-র অপুর মতই ট্রেনের হুইসল ডাকত বিজয়কে। কিন্তু সেই ডাকে যে ভোম্বল সর্দারে মতো বাড়ি ছাড়া হবে বছর সাতেকের খুদেটি— বাবা-মা তা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি। প্রাস মাস দেড়েক পরে, বৃহস্পতিবার সকালে ঘরের ছেলে অবশেষে ঘরে ফিরেছে।

বিজয় চক্রবর্তী। বাড়ি ফুসুরি গ্রামে। ঝাড়খণ্ডের ধানবাদ জেলার নিরসা থানার সেই গ্রামের আশেপাশে কোথাও ট্রেন লাইন নেই। তাই নিয়ে বিজয়ের বরাবর ভারী দুঃখ। তবে উপায় একটা ছিল। বিজয়ের মা বুলুদেবীর মামাবাড়ি আড়শার কাঁটাডিতে। সেই বাড়ির একেবারে কাছেই রেল স্টেশন। ফলে মায়ের মামাবাড়িতে বিজয়েরও ভারী মজা। বুলুদেবী জানান, কাঁটাডি আসার জন্য ছেলের আব্দার লেগেই থাকত। কিছু দিন আগে মায়ের সঙ্গে ট্রেনে চড়ে সেখানে বেড়াতে এসেছিল সে।

গত মার্চের ৩১ তারিখ বিকেলে বাড়ির পাশের মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলতে গিয়েছিল বিজয়। বিকেল গড়িয়ে ঝুপ করে সন্ধ্যা নামে। কিন্তু ছেলের ফেরার নাম গন্ধ নেই। হন্যে হয়ে বুলিদেবী ছেলের সন্ধানে পাড়া চষে ফেলেন। কিন্তু লাভ হয় না। বিজয়ের বন্ধুরাও বলতে পারেনি সে কোন ফাঁকে দল ছাড়া হয়েছে। গোটা এলাকা তন্নতন্ন করে খোঁজার পরে আত্মীয়দের বাড়িবাড়ি যান বিজয়ের বাবা উত্তম চক্রবর্তী এবং মা বুলুদেবী। কিন্তু অনেক চেষ্টাতেও সন্ধান না মেলায় শেষে আত্মীয়দের পরামর্শে ৭ এপ্রিল থানায় গিয়ে নিখোঁজের ডায়েরি করেন তাঁরা।

তারপর একটা মাস কেটে গিয়েছে। ছেলের চিন্তায় প্রায় নাওয়া খাওয়া মাথায় উঠেছিল বাপ-মায়ের। কোথাও অল্প বয়সী ছেলে পাওয়া গিয়েছে বলে খবর কানে এলেই সঙ্গে সঙ্গে সেখানে ছুটে গিয়েছেন। বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে বিজয়ের ছবি দেখিয়ে লোকজনের কাছে জানতে চেয়েছেন, এ রকম কাউকে দেখেছেন কি না। এ ভাবেই দিন কাটছিল। দিন দিন মনমরা হয়ে পড়ছিলেন বুলুদেবী। কোথাও যদি ছেলের খোঁজ মিলে যায় সেই আশায় কাঁটাডি থেকে নড়েননি তিনি।

কিন্তু গত রবিবার ফোনটা আসে ঝাড়খণ্ডের বাড়ি থেকেই। বুলুদেবী বলেন, ‘‘বাড়ি থেকে আমার জা ফোন করেছিলেন। বলেন, এক জন আমার খোঁজে ওই বাড়িতে গিয়েছিলেন।’’ তাঁরা জানতে পারেন, বিজয় রয়েছে ওড়িশার ভুবনেশ্বরের একটি হোমে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা আশড়া থানায় যোগাযোগ করে এই খবর পাওয়ার বিষয়টি পুলিশকে জানান। পুলিশ যোগাযোগ করে ওড়িশার চাইল্ড লাইনে। বিজয়ের ছবি চালাচালি হয়। দুই তরফই নিশ্চিত হওয়ার পরে, উত্তমবাবু এবং বুলুদেবীকে নিয়ে ভুবনেশ্বরের ট্রেনে চাপে পুলিশ।

ওড়িশার চাইল্ড লাইনের থেকে পুলিশ জানতে পারে, গত ১ এপ্রিল ভোরে ভুবনেশ্বর স্টেশনে একা বসেছিল বিজয়। তাকে কাঁদতে দেখে স্থানীয় একজন যোগাযোগ করেন চাইল্ড লাইনের সঙ্গে। বিজয়ের ঠাঁই হয় একটি হোমে। কিন্তু, বাড়ির লোকজন যেমন বিজয়ের খোঁজ করেছে, হোম কর্তৃপক্ষ সে ভাবেই গত দেড় মাসে কি খোঁজ করেছিলেন ছোট্ট ছেলেটির বাবা-মায়ের? হোমের তরফে উত্তমবাবুর কাছে দাবি করা হয়, বিজয়ের ভাষা বুঝতে তাঁদের অসুবিধা হচ্ছিল। বিজয় কথা বলে বাংলাতেই। ঝাড়খণ্ডে বসবাস করার দরুণ সেই বাংলায় একটু হিন্দি টান রয়েছে। হোমের তরফে জানানো হয়, বিজয় বাবা-মায়ের নাম ঠিক করে বললেও তার বাড়ি কোথায় তা বোঝাতে পারেনি।

হোম সূত্রে জানানো হয়, সম্প্রতি বর্ধমানের এক মহিলা সমাজকর্মী ওড়িশার হোমটিতে গিয়েছিলেন। কর্মীরা তাঁর শরণ নেন। অনেক দিন পরে, বাংলায় কথা শুনে বিজয় কাঁদতে কাঁদতে তাঁকে সব বলে। নিজের নাম। বাবার নাম। মায়ের নাম। এমনকী তাদের ঝাড়খণ্ডের বাড়ির কথাও। ঘটনাচক্রে ওই সমাজকর্মীর এক আত্মীয় থাকতেন ঝাড়খণ্ডের ওই এলাকায়। তিনি সেই আত্মীয় মারফৎ খবর পাঠান ফুসুরি গ্রামে।

বৃহস্পতিবার সকালে বিজয়কে নিয়ে পুলিশ ফিরে আসে। এ দিনই পুরুলিয়া আদালতের অনুমতি নিয়ে তাকে বাবা-মায়ের হাতে তুলে দেওয়া হয়। ছেলেকে ফিরে পেয়ে যারপরনাই খুশি উত্তমবাবু এবং বুলুদেবী। ভুবনেশ্বরের হোম কর্তৃপক্ষের গত দেড় মাসে ওড়িশায় কোনও বাঙালি খুঁজে না পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে তাঁরা কিছুটা অবাক হলেও ব্যাপারটা নিয়ে আর মাথা ঘামাতে চান না। বুলুদেবী বলেন, ‘‘এই ক’টা দিন যে কী ভাবে কাটিয়েছি তা আমরাই জানি! ভালয় ভালয় ওকে যে ফিরে পেয়েছে এই ঢের। আর কিছু চাই না। তবে পুলিশকর্মীরা খুবই সাহায্য করেছেন।’’

আর কী বলছে সেই খুদে? গত দেড় মাসে তিন রাজ্য ঘুরে এ দিন ফের সেই কাঁটাডিতেই এসেছে সে। এতটা পথ ট্রেনে চড়ে এসেছে। কিন্তু খুশিতে ডগমগ হওয়ার বদলে শ্রীমান এ বার একটু চুপচাপ। না বলে চলে গিয়েছিলে কেন? ‘‘ট্রেন আমার খুব ভাল লাগে’’, বলে মায়ের আঁচল ধরে বাড়ির পথে হাঁটা দেয় বিজয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Train
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE