Advertisement
১৬ মে ২০২৪
West Bengal Municipal Election 2020

বাঁধের সবুজ জলে স্নান, চুলকোয় গা

‘শহরের ফুসফুস’ হিসেবে পরিচিত ৭৫ একরের জলাশয় সাহেব বাঁধ জাতীয় সরোবরের মর্যাদা পাওয়ার পরে, ভোল বদলাতে শুরু করে।

আগে ছিল। এখন নেই। পুরুলিয়া শহরের দশেরবাঁধ। নিজস্ব চিত্র

আগে ছিল। এখন নেই। পুরুলিয়া শহরের দশেরবাঁধ। নিজস্ব চিত্র

প্রশান্ত পাল
পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ০৩ মার্চ ২০২০ ০০:০৪
Share: Save:

কয়েক পা তফাতেই বৈপরীত্যটা চোখে পড়ে। একটি বাঁধের জল কাচের মত স্বচ্ছ। আবার অনেক বাঁধে ভাসছে প্লাস্টিকের বোতল, পুজোর নৈবেদ্য, খাবারের প্যাকেট এবং মদের বোতল। আলোয় ঝলমল করছে একটির পাড়। অন্যগুলিকে ঘিরে রয়েছে আঁধার। একটির পাড়ের রাস্তা সাফসুতরো। বাকি বাঁধগুলির কোনওটির পাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে শুয়োরের দল, আবার কোনও বাঁধের পাড়ে জমে আবর্জনা। সন্ধ্যা নামলেই কোনও বাঁধের পাড়ে বসে মদের আসর। প্রথমটি সাহেব বাঁধ, যা জাতীয় সরোবরের মর্যাদা পেয়েছে। বাকিগুলি পুরুলিয়া শহরের পুর অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অনাদরে, অভিযোগ বাসিন্দাদের।

‘শহরের ফুসফুস’ হিসেবে পরিচিত ৭৫ একরের জলাশয় সাহেব বাঁধ জাতীয় সরোবরের মর্যাদা পাওয়ার পরে, ভোল বদলাতে শুরু করে। একদা যে বাঁধ আবর্জনায় ভরে থাকত, এখন তার জলে পাতাও ভাসতে দেখা যায় না। জাল আর লোহার গ্রিলের বেড়া দিয়ে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে সাহেব বাঁধের।

কয়েক পা দূরে নতুন বাঁধের চেহারাটা ঠিক তার উল্টো। সেখানে জলে ভাসে ক্যারিব্যাগ, প্লাস্টিকের বোতল, কাগজের ঠোঙা, খাবারের প্যাকেট, ফুল-বেলপাতা, ধূপের প্যাকেট, পুজোর নৈবেদ্য। পাড়ে স্তূপাকারে জমে আবর্জনা। ঘুরে বেড়াচ্ছে শুয়োরের দল। তার পাশেই ঘাটে স্নান সারছেন মানুষজন। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, প্রায় বছর দশেক আগে প্রশাসনের প্রতিশ্রুতি ছিল, এই বাঁধটিও সংস্কার করা হবে। কিন্তু তা হয়নি বলে অভিযোগ।

পুরুলিয়া পুরসভার ১, ২ এবং ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বহু মানুষের ভরসা এই নতুন বাঁধ। তাঁদের একাংশের অভিযোগ, বাঁধের সংস্কার তো দূর অস্ত, দিনে-দিনে নোংরা পড়ে আরও দূষিত হয়েছে জলাশয়। এখন সেখানে প্রতিমা বিসর্জন হয়। স্থানীয় বাসিন্দা সাজেন বাউরি, রোহেন বাউরির কথায়, ‘‘স্নান করার জন্য ভরসা বলতে এই বাঁধ। জল সবুজ রং নিয়েছে। স্নান করলে শরীর চুলকায়।’’

জেলার বিশিষ্ট গবেষক দিলীপকুমার গোস্বামী জানান, ১৮৩৮ সালে মানবাজার থেকে মানভূমের সদর পুরুলিয়ায় সরে আসার পরে, মানভূমের তৎকালীন ডেপুটি কমিশনার কর্নেল টিকেল সাহেব জেলের কয়েদিদের দিয়ে বিশাল জলাশয় খনন করিয়েছিলেন। সেকারণেই তার নাম হয় সাহেব বাঁধ। সাহেব বাঁধের উদ্বৃত্ত জল দু’টি স্লুইস গেটের মাধ্যমে নতুন বাঁধে পড়ত।

শহরের ১৯ ও ২০ নং ওয়ার্ডের সংযোগ স্থলে রয়েছে পোকা বাঁধ। গিয়ে দেখা গিয়েছে, বাঁধের জলে ভাসছে প্লাস্টিকের গ্লাস-বোতল, ক্যারিব্যাগ-সহ নানা আবর্জনা। জলের রং সবুজ। ঠিক যেন কেউ জলে সবুজ রং ঢেলে দিয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য, উন্নয়ন বলতে শুধু বাঁধের পাড়ে আলো লাগানো হয়েছে। বাঁধের পাশের নিকাশি নালা বুজে গিয়েছে প্লাস্টিকে। বর্ষায় নালা উপচে নোংরা জল বাঁধের জলে মেশে। এক বাসিন্দার অভিযোগ, সন্ধ্যার পরেই বাঁধের পাড়ে মদ্যপানের আসর বসে। আসর শেষে অনেকে মদের বোতল জলে ফেলে দেন। দামোদর ধীবর, অসিত বাউরির অভিযোগ, ‘‘পোকাবাঁধের জলে স্নান করলে গায়ে চুলকানি হয়। চিকিৎসা করাতে হয়।’’

পোকা বাঁধের কিছুটা দূরেই রয়েছে পদ্ম বাঁধ। এক সময় সেখানে পদ্ম ফুটত। স্নানের জন্য চাটানিপাড়া, পোকাবাঁধ পাড়া, জেলিয়াপাড়া, চাষাপাড়া, সরুবাইদপাড়ার বাসিন্দাদের ভরসা এই বাঁধের জলেও ভাসতে দেখা গিয়েছে প্লাস্টিকের গ্লাস ও মদের বোতল। পাড়ে জমে আবর্জনা। সংস্কার বলতে বাঁধের পাড়ে গাছ বসানো হয়েছে। আর হয়েছে আলোর ব্যবস্থা। স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, রাতের অন্ধকারে ওই বাঁধের পাড়েও মদ্যপানের আসর বসে। খালি মদের বোতল ছুড়ে ফেলা হয় জলে। খোকন কর্মকার নামে এক বাসিন্দার কথায়, ‘‘অনেকদিন বাঁধের সংস্কার হয়নি। জলও ভাল নয়। এই জলেই স্নান সারতে হয়।’’

একই ছবি রথতলা ও তেলকলপাড়ার মাঝে থাকা বুচা বাঁধেরও। এলাকাবাসীর অনেকেই ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘‘জলে মদের বোতল থেকে শুরু করে প্লাস্টিকের গ্লাস—অনেক কিছুই ফেলা হয়।’’ বাবু কর্মকার, বাবলু বাউরির অভিযোগ, ‘‘নিকাশি নালার জলও মেশে বাঁধে।’’

শহরের ১০ নম্বর ওয়ার্ড লাগোয়া এলাকার বাসিন্দাদের ভরসা বলতে ছিল রাজা বাঁধ। দেখা গিয়েছে, সেই বাঁধের জলও সবুজ হয়ে গিয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা দেবদাস দরিপার কথায়, ‘‘বাঁধের জল খুবই নোংরা। নিকাশি নালার জলও মেশে বাঁধের জলে।’’ পুরুলিয়া শহরের নাজির বাঁধ, দশের বাঁধ, রতন গড়িয়ার মতো বহু জলাশয়ের সংস্কার হয়নি বলে অভিযোগ।

পুরসভার বিরোধী দলনেতা কংগ্রেসের সুদীপ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বাঁধগুলির অস্তিত্ব বিপন্ন। অনেক আন্দোলনের পরে, সাহেব বাঁধ রক্ষায় কিছু পদক্ষেপ করা গিয়েছে। জলাশয়গুলি যে শহরের ভারসাম্য রক্ষা করে, সেটা বুঝতে হবে।’’

সমাজকর্মী আবু সুফিয়ানের বক্তব্য, ‘‘সাহেব বাঁধ ছাড়া, বাকি জলাশয়গুলি বাঁচানোর তেমন উদ্যোগ চোখে পড়ছে না।’’

পুরুলিয়ার তৃণমূল উপ পুরপ্রধান বৈদ্যনাথ মণ্ডল বলেন, ‘‘দু’-একটি বাঁধের কাছে অসামাজিক কাজকর্ম চলার খবর পেয়ে সেখানে পার্ক তৈরি হয়েছে। আলো লাগানো হয়েছে। সাহেব বাঁধের দূষণের মোকাবিলা করা গিয়েছে। অন্য জলাশয়গুলি সংস্কারের মতো তহবিল পুরসভার নেই। এই সমস্যা নিয়ে প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করব।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

West Bengal Municipal Election 2020 Purulia
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE