Advertisement
১৮ মে ২০২৪

ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে বলরাম জীউ

বলরাম জীউ মন্দির। খয়রাশোলের নাম উঠলে অবশ্যই শতাব্দী প্রাচীন এই মন্দিরের প্রসঙ্গ চলে আসে। তার মূলত দু’টি কারণ। এক— জেলা ও জেলার বাইরে এই মন্দিরকে ঘিরে ভিন্ন পরিচিতি। দুই— এই মন্দিরে সৌজন্যে প্রাপ্ত এখনও পর্যন্ত খয়রাশোলের সবচেয়ে বড় উৎসব গোষ্ঠমেলা। ইতিহাস বলছে, মঙ্গলডিহি থেকে বলরাম বিগ্রহ নিয়ে আনুমানিক সাড়ে চারশো বছর আগে খয়রাশোলে আসেন মন্দিরের সেবাইতদের পূর্বপুরুষেরা। তাঁরা খয়রাশোলের আদিতম বাসিন্দা না হলেও আদি বাসিন্দা অবশ্যই।

বলরাম প্রভুজীউর মন্দির। (ডান দিকে) বলরাম ও রেবতীর বিগ্রহ। — নিজস্ব চিত্র

বলরাম প্রভুজীউর মন্দির। (ডান দিকে) বলরাম ও রেবতীর বিগ্রহ। — নিজস্ব চিত্র

দয়াল সেনগুপ্ত
খয়রাশোল শেষ আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০১৪ ০২:৪৫
Share: Save:

বলরাম জীউ মন্দির। খয়রাশোলের নাম উঠলে অবশ্যই শতাব্দী প্রাচীন এই মন্দিরের প্রসঙ্গ চলে আসে। তার মূলত দু’টি কারণ। এক— জেলা ও জেলার বাইরে এই মন্দিরকে ঘিরে ভিন্ন পরিচিতি। দুই— এই মন্দিরে সৌজন্যে প্রাপ্ত এখনও পর্যন্ত খয়রাশোলের সবচেয়ে বড় উৎসব গোষ্ঠমেলা।

ইতিহাস বলছে, মঙ্গলডিহি থেকে বলরাম বিগ্রহ নিয়ে আনুমানিক সাড়ে চারশো বছর আগে খয়রাশোলে আসেন মন্দিরের সেবাইতদের পূর্বপুরুষেরা। তাঁরা খয়রাশোলের আদিতম বাসিন্দা না হলেও আদি বাসিন্দা অবশ্যই। খয়রাশোলকে পরিচিতি দেওয়ার পেছনেও তাঁদের একটা বড় অবদান রয়েছে। বংশ পরম্পরায় মূলত গুরুগিরিকেই পেশা করার জন্য জেলার বিভিন্ন প্রান্ত, এমনকী পড়শি ঝাড়খণ্ড ও বর্ধামান থেকে তাঁদের অনেক শিষ্য এখানে যাতায়াত করতেন বলে একদা প্রত্যন্ত গ্রাম খয়রাশোল একটা ভিন্ন পরিচিতি ছিল। সেই যাতায়াত এখনও অক্ষুণ্ণ রয়েছে বলে জানিয়েছেন সেবাইতরা।

মূলত ঠাকুর উপাধিধারী সেবাইতদের মধ্যে বয়জ্যেষ্ঠ অশিতিপর ভক্তিপদ ঠাকুর (যিনি গাঁধী ঠাকুর নামেই পরিচিত) বলছেন, “বিভিন্ন বইপত্র, বীরভূমের ইতিহাস ঘেঁটে যা পেয়েছি, তা অনেকটা এই রকম— শ্রী চৈতন্যদেবের পরবর্তী সময়ের সময়টা বাংলা ১৫০০ শতকের মাঝামাঝি হবে। নিত্যানন্দদেবের স্নেহধন্য ঠাকুর সুন্দরানন্দের শিষ্য বীরভূমের মঙ্গলডিহি গ্রামের বাসিন্দা পর্ণগোপাল ঠাকুরের কাছে বলরামচাঁদ (বলরাম) ও শ্যামচাঁদ (কৃষ্ণ) দু’টি বিগ্রহ রেখে দিয়ে ব্রজ গোস্বামী নামে এক ব্যক্তি পুরী ভ্রমণে গিয়েছিলেন। কথিত আছে, সেই সময় বিগ্রহ দু’টির পুজার্চনা ভীষণ ভক্তিভরে করেন পর্ণগোপালের স্ত্রী ও বোন।” তিনি জানিয়েছেন, ব্রজ গোস্বামী পুরী থেকে ফিরে এসে বিগ্রহ দু’টি নিতে আর নিয়ে যেতে পারেননি। স্পাপ্নাদেশ পাওয়ার পর ব্রজ গোস্বামী বলরাম ও শ্যাম চাঁদ বিগ্রহ দু’টি পর্ণগোপালের কাছেই রেখে গিয়েছিলেন। নিঃসন্তান পর্ণগোপাল ঠাকুরের পাঁচ পোষ্য পুত্রের একজন অনন্তগোপাল ঠাকুরের বংশধরেরাই দু’টি বিগ্রহের একটি বলরামচাঁদ নিয়ে খয়রাশোলে এসেছিলেন। ওঁরাই তাঁদের পূর্বপুরুষ বলে জানালেন ভক্তিপদ ঠাকুর। তিনি বলেন, “আমাদের ধারণা, সেই সময় বিহারে (অধুনা ঝাড়খণ্ড) তৎকালীন সেই সময়কার শিষ্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার সুবিধার জন্যই এমনটা তাঁরা করেছিলেন। কারণ, খয়রাশোলের সঙ্গে বিহারের যোগযোগ বেশ ভালোই ছিল। সেবাইতদের অনেকেই এখন ভিন্ন পেশায়। তবুও তাঁরা গুরুগিরি ছাড়তে পারছেন না। কাগজে কলমে ৪২ ঘর সেবাইত (যদিও শরিকের সংখ্যা এখন প্রায় ৬৫টি ঘর) পরিবারের মিলিত শিষ্য সংখ্যা বর্তমানে কয়েক হাজার।”

সাড়ে চারশো বছর আগের সেই মাটির মন্দির ধীরে ধীরে বদলে হয়েছে পাকা মন্দির। শিষ্যদের দানে মূল বলরাম মন্দির ও নাট্যশালার সামনে বছর কয়েক আগেই তৈরি হয়েছে সুদৃশ্য তোরণ। বলরামের মূর্তির পাশে রেবতী মূর্তি। এ ছাড়াও, রাধা, কৃষ্ণ, গোপাল এবং একাধিক শালগ্রামশিলা রয়েছে। মন্দিরে নিয়মিত ভোগ, পুজো, আরতি চলে। পালা করে সেই দায়িত্ব শরিকেরা পালন করেন বলে জানিয়েছেন, বলরাম সেবাইত সমিতির রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর, জগন্নাথ মুখোপাধ্যায়রা। তাঁরা আরও জানান, জন্মাষ্টমী, রথযাত্রা, দোল এবং গোষ্ঠাষ্টমী পালিত হয় বলরাম মন্দিরে। তবে সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ গোষ্ঠাষ্টমী কার্তিক মাসের শুক্লাষ্টমী তিথিতে পালিত হয়। কৃষ্ণ ও বলরাম গোচারণে গোষ্ঠে গিয়েছিলেন, এটা মেনেই বহু বছর ধরে ওই উৎসব পালিত হয়ে আসছে। তখনই বসে গোষ্ঠমেলা। প্রাচীন দুর্গাপুজো বা ছোটখাটো অনুষ্ঠান থাকলেও খয়রাশোলবাসীর কাছে গোষ্ঠমেলাই সবচেয়ে বড় উৎসব। মেলাটি সেবাইতদেরই নিয়ন্ত্রণে থাকলেও সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছেন গোটা খয়রাশোলের মানুষ এবং প্রশাসন। তার পেছনে কারণও রয়েছে। শুধু খয়রাশোল গ্রামে নয় গোটা ব্লকের মধ্যেই পার্ক, সিনেমা হলের মতো বিনোদনকেন্দ্র বা নাটক, বড়ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান না থাকা।

কালীপুজো, ভাইভোঁটার ঠিক পরে গোষ্ঠমেলাই তাই বিনোদনের বড় উৎসব। মেলার পাশাপাশি হয় দু’দিনের যাত্রাপালাও। ওই বিশেষ দিনটিতে বলরাম বিগ্রহকে শোভাযাত্রা সহকারে মেলাপ্রাঙ্গণে নিয়ে আসা হয়। গোষ্ঠের দিন মন্দির থেকে বিগ্রহ নিয়ে গিয়ে মেলা প্রাঙ্গণে রাখা হয় রাত ৮টা পর্যন্ত। তার পরে বিগ্রহ মন্দিরে ফিরিয়ে আনা হয়। প্রভু গোচারণে গিয়েছেন এটা মেনেই দুপুরে থালায় থালায় ভোগ নিয়ে যাওয়া হয় মেলার মাঠে। চলে পুজো, আরতি। যখন কমপক্ষে ৫০-৬০টি থালায় ভোগ পাঠানো হয় সেটা দেখার মতো। সন্ধ্যারতির পর বিগ্রহ মন্দিরে ফিরে গেলেও তিন দিন ধরে চলে মেলা। সেই সময়টায় সেবাইতদের পরিবার তো বটেই, খয়রাশোলের বাড়িতে বাড়িতে এই সময় আত্মীয়স্বজন আসেন। গ্রামের বধূ শিপ্রা ঘোষ, লক্ষ্মী দাস, প্রমীলা রজক, কবিতা ঘোষদের কথায়, “দারুণ কাটে ওই সময়টা। তাই কোনও ভাবেই গোষ্ঠমেলা হাতছাড়া করতে চাই না। সারা বছর আমরা মেলার জন্য মুখিয়ে থাকি।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE