পুলিশি হেফাজতে এরিক সোরেনের মৃত্যুর পরে ক্ষোভে পথে নামলেন বাসিন্দারা। দুই পুলিশ আধিকারিকের গ্রেফতারির দাবিতে আনাড়ায় বুধবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পথ অবরোধ করলেন বাসিন্দারা।
এলাকায় তিনি নির্বিবাদী হিসাবেই পরিচিত ছিলেন। ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ে পড়া ছেড়ে দিয়েছিলেন। সম্প্রতি শুরু করেছিলেন সাউন্ডবক্স ভাড়া দেওয়ার ব্যবসা।
পুলিশি হেফাজতে এ রকম এক যুবক এরিক সোরেনের মৃত্যুতে তাই স্বাভাবিক ভাবেই ক্ষোভ ছড়িয়েছে পুরুলিয়ার আনাড়া রেল কলোনি এলাকায়। এলাকাতেই একটি চুরির ঘটনায় সন্দেহভাজন হিসাবে রেলকর্মীর ছেলে এরিককে পুলিশ বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল মঙ্গলবার সন্ধ্যায়। আর বুধবার ভোরে তাঁকে যখন রঘুনাথপুর হাসপাতালে নিয়ে যায় পাড়া থানার পুলিশ, ততক্ষণে নিথর হয়ে গিয়েছে তাঁর দেহ। পরিবারের প্রশ্ন, তাঁরা মঙ্গলবার রাতেও পাড়া থানার লক-আপে সুস্থ অবস্থায় দেখেছিলেন ২১ বছরের এরিককে। তা হলে পরের কয়েক ঘণ্টায় এমন কী ঘটল, যে সুস্থ ছেলেটা মারা গেল?
বুধবার দিনভর এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন রেল কলোনির বাসিন্দারাও। কিন্তু, জেলা পুলিশের কাছ থেকে এ ব্যাপারে কোনও উত্তরই পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে, এ দিন স্থানীয় মানুষের সমস্ত ক্ষোভ গিয়ে পড়ে পুলিশের উপরেই। এরিকের মৃত্যুর জন্য পাড়া থানার ওসি নীলরতন ঘোষ ও আনাড়া ফাঁড়ির ইন-চার্জ পঙ্কজ গুপ্তকে দায়ী করে তাঁদের গ্রেফতারির এবং তাঁদের বিরুদ্ধে খুনের মামলা দায়ের করার দাবিতে এ দিন সকাল থেকেই পুরুলিয়া-বরাকর রাজ্য সড়ক অবরোধ করে উত্তেজিত জনতা। মৃতের পরিবারকে আর্থিক ক্ষকিপূরণ এবং পরিবারের এক জনকে সরকারি চাকরি দেওয়ার দাবিও তোলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। পরিস্থিতির আঁচ বুঝে অবরোধ তুলতে পুলিশও আর বলপ্রয়োগের পথে হাঁটেনি। ফলে, আর সেই অবরোধ চলল রাত পর্যন্ত। অবরোধের জেরে ভোগান্তিতে পড়লেন বহু মানুষ। আসানসোল থেকে বোকারো ট্রাক নিয়ে যাচ্ছিলেন সন্তোষ প্রভু ও সুরেশ সাউ। সকাল থেকে অবরোধে আটকে থাকা এই দুই ট্রাক চালক রাতে বলেন, “এখনও অবরোধ ওঠেনি। ছোট গাড়িগুলো অন্য রাস্তা দিয়ে যেতে পারলেও ট্রাক নিয়ে আমরা ঠায় এখানেই দাঁড়িয়ে আছি। কখন বোকারো পৌঁছব জানি না।”
এ দিন আনাড়ায় গিয়ে দেখা যায় শ্মশানের অদূরে রাজ্য সড়কের উপরে গাছের গুঁড়ি, ড্রাম ফেলে অবরোধ করছেন শতাধিক এলাকাবাসী। প্রায় দুই কিলোমিটার পর্যন্ত সার দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে গাড়ি। ঘটনাস্থলে উপস্থিত পুলিশ, প্রশাসনের কর্তাদের ঘিরে চলছে তুমুল বিক্ষোভ। প্রথমে অবরোধ তুলতে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন জেলা পুলিশের ডিএসপি কুন্তল বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রঘুনাথপুরের এসডিপিও পিনাকী দত্ত। পরে যান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার দ্যুতিমান ভট্টাচার্য। দুপুর পর্যন্ত অবরোধ না ওঠায় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট অজয় সেনগুপ্তকে নিয়ে আনাড়ায় যান রঘুনাথপুরের মহকুমাশাসক সুরেন্দ্র কুমার মীনা। বিকেলে আনাড়া ফাঁড়িতে মৃতের পরিবার ও কিছু স্থানীয় বাসিন্দার সঙ্গে আলোচনায় বসেন মহকুমাশাসক। তাতেও বরফ গলেনি। পরে ফের রঘুনাথপুরে নিজের অফিসে বৈঠক করেন মহকুমাশাসক। অবরোধ ওঠেনি তাতেও।
অবরোধকারীরা পুলিশের শাস্তির দাবিতে অনড়ই থেকেছেন। তাঁদের অভিযোগ, “পুলিশ এলাকায় মদ, জুয়ার ঠেক ভাঙার বেলায় তৎপরতা দেখায় না। অথচ নির্দোষ একটা ছেলেকে বিনা কারণে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গেল। ছেলেটা পুলিশের হেফাজতে মারাও গেল!” এরিকের প্রতিবেশীদেরও দাবি, ওই যুবকের বিরুদ্ধে আগে কোনও অপরাধমূলক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ নেই। তবু তাঁকে কেন চুরির অভিযোগে পুলিশ ধরল, তা তাঁরা বুঝতে পারছেন না। স্থানীয় বাসিন্দা বিশ্বজিৎ সিংহ, জহর দাস, বিপ্লব দেওঘরিয়াদের দাবি, “যে রেলকর্মীর বাড়িতে চুরি হয়েছিল, তিনি এরিকের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগই থানায় করেননি। তবু পুলিশ ওই চুরির ঘটনাতেই এরিককে তুলে নিয়ে গেল। আমরা জানতে চাই, মঙ্গলবার রাতে লক-আপে কী হয়েছিল? এর উত্তর না পেলে আমাদের আন্দোলন চলবে।” এরিকের বোন লিলি সোরেন বলেন, “মঙ্গলবার রাতে পাড়া থানার লক-আপে দাদাকে যখন দেখতে যাই, তখন ও বলেছিল, ‘আমি কিছু করিনি। পুলিশ শুধু শুধু আমাকে ধরল। এখান থেকে আমাকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা কর’। আমরা ওসি-কে সে কথা বারবার বললেও তিনি কানে তোলেননি।”
বস্তুত, এ দিন অবরোধস্থলে যাওয়া জেলা পুলিশের শীর্ষ কর্তাদের সামনে যে ভাবে স্থানীয় পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়েছে জনতা, তাতে পরিষ্কার, এলাকায় পুলিশের কাজকর্ম নিয়ে আগে থেকেই রাগ জমেছিল। এরিকের মৃত্যুতে সেই ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। তবে ওই ঘটনায় রাজনীতির রংও লেগেছে। আজ, বৃহস্পতিবার আনাড়ায় বন্ধ ডেকেছে বিজেপি। দলের পুরুলিয়া জেলা সভাপতি বিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “ওই এলাকায় অপরাধমূলক কাজকর্ম বাড়ছে। পুলিশের সে-সব নিয়ন্ত্রণ করার উদ্যোগ নেই। পরিবর্তে পুলিশ এ দিন যা কাণ্ড ঘটিয়েছে, তা কোনও ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। পুলিশি হেফাজতে একটা নিরীহ ছেলেরে কী ভাবে মৃত্যু হল, তার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দরকার। এ সব দাবিতেই আমাদের বন্ধ।”
যদিও তাদের হেফাজতে এরিকের উপরে কোনও অত্যাচার করা হয়নি বলে দাবি করেছে জেলা পুলিশের একাংশ। সেই সূত্রের দাবি, চোরাই মালের হদিস পেতে মঙ্গলবার রাতে এরিককে নিয়ে কয়েকটি এলাকায় যাওয়া হয়েছিল। পথেই অসুস্থ হয়ে পড়ায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। কিন্তু, সময় পাওয়া যায়নি।
ছবি: পৌলমী চক্রবর্তী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy