Advertisement
E-Paper

নতুন প্রজন্ম ঝুঁকছে ই-কার্ডে

বছরের শেষ সপ্তাহ মানেই গ্রিটিংস কার্ড কিনতে হুড়োহুড়ি। স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের জমাটি ভিড়। দিনের শেষে কার্ড বিক্রির টাকা গুনতে গুনতে ব্যবসায়ীদের মুখে হাসি। কিন্তু এসএমএস, ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপের গুঁতোয় এ সবই কার্যত এখন ইতিহাস হতে বসেছে। বর্তমানে ১১টা ৫৯মিনিট বাজতে না বাজতেই মুহূর্তেই শুভেচ্ছা বার্তা পৌঁছে যাচ্ছে প্রিয়জনদের কাছে। এই পরিস্থিতিতে এমনই শহরের বহু নামিদামি দোকান এখন নতুন বছরের শুভেচ্ছা লেখা কার্ড রাখাই বন্ধ করে দিয়েছে।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:৪৯
হোয়াটস অ্যাপে পাঠানো হচ্ছে শুভেচ্ছা বার্তা।

হোয়াটস অ্যাপে পাঠানো হচ্ছে শুভেচ্ছা বার্তা।

বছরের শেষ সপ্তাহ মানেই গ্রিটিংস কার্ড কিনতে হুড়োহুড়ি। স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের জমাটি ভিড়। দিনের শেষে কার্ড বিক্রির টাকা গুনতে গুনতে ব্যবসায়ীদের মুখে হাসি।

কিন্তু এসএমএস, ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপের গুঁতোয় এ সবই কার্যত এখন ইতিহাস হতে বসেছে। বর্তমানে ১১টা ৫৯মিনিট বাজতে না বাজতেই মুহূর্তেই শুভেচ্ছা বার্তা পৌঁছে যাচ্ছে প্রিয়জনদের কাছে। এই পরিস্থিতিতে এমনই শহরের বহু নামিদামি দোকান এখন নতুন বছরের শুভেচ্ছা লেখা কার্ড রাখাই বন্ধ করে দিয়েছে। তাঁদের অনেকেরই অভিমত, বর্তমানে কার্ডের পিছনে টাকা ঢালাটা বেশ ঝুঁকির।

কার্ড বিক্রি কমেছে বোলপুর-শান্তিনিকেতন এলাকায়। সেই সঙ্গে ই-কার্ডের প্রচলন সমান পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। শান্তিনিকেতনের রতনপল্লি এলাকার ব্যবসায়ী রাজর্ষি চন্দ্র বলেন, “অন্য বার ১৫-২০ হাজার টাকার কার্ড বিক্রি হত। গত বছর দু’য়েক ধরে কমেছে। এ বার একবারেই নেই বললে চলে। তাও গ্রাহক ফেরাবো না বলে হাজার দু’য়েক টাকার স্টক রেখেছি।” এ দিকে, শ্রীনিকেতন রোড়ের হোলসেল কার্ড বিক্রেতা সুদীপবাবুর দাবি, এই মরসুমে অন্তত পক্ষে চল্লিশ হাজারের মত বাজার থাকত। কিন্তু বছর তিনেক ধরে বাজার সেই অর্থে হয় না। শান্তিনিকেতন রোড়ের ওপর খাতাপত্র দোকানদার মুখোপাধ্যায় বলেন, “আমার দোকানে কার্ডের স্টক সেই অর্থে নেই। তবে কয়েক বছর ধরে স্টকে থাকা কার্ডগুলি বিক্রি করার চেষ্টা করছি।”

সত্যপ্রকাশ তিওয়ারি নামে দুবরাজপুরের এক ব্যবসায়ী বহু বছর ধরে কার্ড বিক্রি করতেন। তিনি বলছেন, “মূলত ১২-২২ বছরের ছেলেমেয়েদের মধ্যেই কার্ড কেনার হিড়িক বছর চার-পাঁচ আগেও যথেষ্ট বেশি ছিল। শুধু এই মরসুমে ২০ হাজার টাকার কার্ড বিক্রি করেছি। কিন্তু মোবাইল, স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের রমরামায় কার্ড বিক্রি ধীরে ধীরে এতটাই কমে যাচ্ছিল যে বছর দুই ধরে কার্ড বিক্রি সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছি।” কার্ড বিক্রি যে দিন দিন কমছে তা মানছেন দুবরাজপুরে অপর এক ব্যবসায়ী ভক্ত দত্তমুদীও।

কিন্তু কার্ড দেওয়ার রীতি থেকে দূরে সরে থাকার কারণ কী? একটি বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সিউড়ির বাসিন্দা অনিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “যখন স্কুলে পড়তাম নতুন বছর এলেই কার্ডের দোকানে গিয়ে বন্ধুদের শুভেচ্ছা জানানোর জন্য কার্ড কিনতাম। এখন তার আর প্রয়োজন নেই।” কার্ড কেনার প্রয়োজন ফুরিয়েছে খয়রাশোলের তরুণী নাতাশা সরকার, সদাইপুর থানা এলাকার বাসিন্দা কলেজ পুড়ুয়া পায়েল কোনাই বা রাজনগরের সুস্মিতা রুজদের। কারণ, ফেসবুক, ট্যুইটারের মতো সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট, হোয়াটসঅ্যাপের মতো ম্যাসেজিং অ্যাপ্লিকেশন সিস্টেমে অনেক বেশি সড়গড় বর্তমান প্রজন্ম। তার জন্য চাই একটা স্মার্টফোন। আর স্মার্ট ফোন না থাকলে মেসেজ পাঠানোর জন্য তো একটি সাধারণ মোবাইলই যথেষ্ট। সকলেই বলছেন, এত দ্রুত বন্ধু, আত্মীয়েদর সঙ্গে যোগাযোগ করার উপায় যেখানে রয়েছে, সেখানে সময় ও অতিরিক্ত পয়াসা খরচ করে কার্ড কিনতে যাব কেন! বিশেষ কাউকে দেওয়ার জন্য কার্ডের গুরুত্ব আছে ঠিকই। কিন্তু বছর কয়েক আগেও যেভাবে নতুন বছর শুরুর আগে কার্ডের দোকানে গিয়ে ভিড় জমাতাম এখন সেটা করতে হয় না।

প্রায় ফাঁকা বোলপুরের একটি কার্ডের দোকান।

বিভিন্ন কার্ডের দোকানে ভিড় চোখে না পড়লেও, বৃহস্পতিবার বোলপুর-শান্তিনিকেতন এলাকার একাধিক সাইবার কাফে, ইন্টারনেট ধাবাগুলিতে দেখা গেল স্কুল পড়ুয়া থেকে শুরু করে সব বয়সের মানুষের ভিড়। ইন্টারনেটের ওই পরিষেবা ব্যাবহারকারীরা যেমন রয়েছেন, তেমনই ব্যবহার করতে না পারা মানুষজনও রয়েছেন। ওই দোকানগুলির লোকজনের সাহার্যে কেউ ভিন রাজ্য বা ভিন দেশে শুভেচ্ছা পাঠাচ্ছেন। তো কেউ আবার আশপাশের মানুষজনের কাছে ইংরেজি নববর্ষের শুভেচ্ছা বার্তা পাঠাচ্ছেন। তেমনই ইন্টারনেট পরিষেবা দেওয়া বোলপুর-শান্তিনিকেতন এলাকার দোকানগুলির অন্যতম বলাই প্রসূন ভট্টাচার্য, দেবাশিস চট্টোপাধ্যায়, কাঞ্চন সাহা, বাপ্পাদিত্য কুমার ও পরিমল ঘোষেরা বলছেন, “ইদানিংকালে সকলে মোবাইলে যাবতীয় ইন্টারনেট বিষয়ক পরিষেবা ব্যাবহার করেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও ৩১ ডিসেম্বর, ১ জানুয়ারির মতো দিনগুলিতে শুভেচ্ছা বিনিময় করার জন্য গ্রাহকদের ভিড় উপচে পড়ে। অনেক গ্রাহক নিজেরাই ব্যবহার করেন, আবার অনেকে আমাদের সহায়তা নিয়ে ব্যবহার করেন। ই-কার্ড ব্যাবহারকারীদের সংখ্যাও কিন্তু নেহাত কম নয়। স্কুল পড়ুয়া থেকে শুরু করে সব বয়সের মানুষজন ই-কার্ড কিন্তু দেদার ব্যবহার করছেন।”

তবে সব কার্ড বিক্রেতা সেটা মানছেন এমনটা নয়। সিউড়ি শহরে জেলাস্কুল লাগোয়া রাস্তায় দীর্ঘ দিন ধরে কার্ড বিক্রি করছেন গৌতম গড়াই। তাঁর কথায়, “কার্ডের বাজার এ বার যথেষ্ট ভাল। গত বার ৪৫ হাজার টাকার কার্ড বিক্রি করেছি। এ বার এখনও পর্যন্ত ৬০ হাজার টাকার কার্ড বিক্রি হয়েছে। স্কুলপড়ুয়া থেকে তাদের অভিভাবক, কমবয়সী ছেলেমেয়ে এবং প্রশাসনিক কর্তাদের কাছেও আমার দোকান থেকে কার্ড গিয়েছে।” প্রযুক্তির প্রভাব কি কার্ডের বাজারে সে আর্থে পড়েনি? গৌতমবাবু বলছেন, “দু’টি জায়গায় সমস্যা হচ্ছে। এক, বিভিন্ন রুচি ও বয়স নির্ভর কার্ড রাখতে হবে। যা অনেকই ঠিকমত রাখেন না। দ্বিতীয়ত বই বা অন্য দোকান থেকেই কার্ড বিক্রি হয়ে থাকে। অধিকাংশ জায়গায় শুধু কার্ড বিক্রি কেউ করছেন এমন সংখ্যা খুব কম। তা ছাড়া সকলেই স্মার্টফোন ইন্টারনেট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে ভাবলে ভুল হবে।”

প্রায় একই বক্তব্য রামপুরহাট শহরের পাঁচমাথা মোড়ের ব্যবসায়ী শতদল নাগের। তিনি বলেন, “বাজার ঠিকই আছে। সাত বছর বয়স থেকে কার্ড বিক্রি করছি। ছোট কার্ডের চাহিদা নেই। বড় ফোল্ডিং কার্ডের চাহিদা বেশি। যেমন ১২০-১৫০ টাকা দামের। সব রকমের কার্ডের চাহিদা সেই অর্থে নেই। তবে বিক্রি একটু কমেছে।” এ দিন শহরের কার্ডের দোকানে গিয়ে দেখা গেল, বাংলা হরফে লেখা, ‘তুমি সুখে থাক’, ‘সারা বছর ভাল কাটুক’, ‘তোমার আমার ভালবাসা’ লেখা কার্ড দেদার ঝুলছে। কার্ডের চাহিদাও রয়েছে তুঙ্গে। তবে সেই ক্রেজ কিন্তু আর নেই। কমেছে। দারুল ইসলাম কার্ড বিক্রেতার বক্তব্য, “ঝাঁকে ঝাঁকে যুব প্রজন্মের কার্ডের দোকানে ভিড় নেই। ৩১ ডিসেম্বর ৫০০০ টাকার কিছু বেশি কার্ড বিক্রি হয়েছে। প্রায় আঠারো বছর ধরে এই ব্যাবসার সঙ্গে যুক্ত আছি। ছোট কার্ডের বিক্রি নেই।” কার্ড বিক্রেতা নিয়ামত আলি বলেন, “কার্ডের ব্যবসা করি ঠিকই। তবে এই বার তুলনামূলক ভাবে কার্ড থেকে ক্যালেন্ডার, ডায়েরি বেশি রেখেছি। অন্য বার ২০ হাজার টাকা মাল রাখি। এ বার দশ হাজার টাকার মাল রেখেছি।”

কার্ড ব্যবহারকারীদের মন্তব্যেও মতপার্থক্য রয়েছে। রামপুরহাটের এক বাসিন্দা সৈয়দ আরিফ হুসেন বলেন, “কার্ড ব্যাবহার আর করি না। সহজলভ্য হচ্ছে ইন্টারনেট, ওয়াটসঅ্যাপ।” রামপুরহাট হাইস্কুল ফর গার্লসের ছাত্রী রুবি, পুজাদের কথায়, “কার্ড কিনতেই ভালবাসি।” সিউড়ির গৃহবধূ অদৃজা দত্ত, রবীন্দ্রভারতীর ছাত্রী দেবযানী দত্তরা বললেন, “এখন কার্ডের চল যথেষ্ট কমেছে। তবে বিশেষ কারও জন্য শুভেচ্ছা জানাতে পছন্দসই কার্ডই সেরা উপায়। তাতে আন্তরিকতা অনেক বেশি থাকে।”

ছবি: অনির্বাণ সেন ও বিশ্বজিত্‌ রায়চৌধুরী।

new year greetings e-card
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy