Advertisement
০২ মে ২০২৪

প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে সবাইকে পিছনে ফেলেছে অঙ্কিতা-সাগ্নিক

তারা আর পাঁচটা ছেলেমেয়ের মতো নয়। জন্ম থেকেই মস্তিস্কের পক্ষাঘাত জনিত রোগ বা সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত। সব প্রতিবন্ধকতাকে হারিয়ে সেই সাগ্নিক আর অঙ্কিতাই সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। এ বারের মাধ্যমিকে দু’জনের ফল গর্বিত করেছে তাদের বাবা-মায়েদেরও।

সাগ্নিক কুণ্ডু ও অঙ্কিতা সরকার।—নিজস্ব চিত্র।

সাগ্নিক কুণ্ডু ও অঙ্কিতা সরকার।—নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
সিউড়ি শেষ আপডেট: ২৮ মে ২০১৪ ০১:৫৯
Share: Save:

তারা আর পাঁচটা ছেলেমেয়ের মতো নয়। জন্ম থেকেই মস্তিস্কের পক্ষাঘাত জনিত রোগ বা সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত। সব প্রতিবন্ধকতাকে হারিয়ে সেই সাগ্নিক আর অঙ্কিতাই সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। এ বারের মাধ্যমিকে দু’জনের ফল গর্বিত করেছে তাদের বাবা-মায়েদেরও। তারা সিউড়ির সমন্বয় পল্লির সাগ্নিক কুণ্ডু এবং রামকৃষ্ণ পল্লির অঙ্কিতা সরকার। সিউড়ি আরটি গার্লসের ছাত্রী অঙ্কিতা পেয়েছে ৯১ শতাংশেরও বেশি নম্বর। আবার সিউড়ি পি অ্যান্ড চন্দ্রগতি মুস্তাফি মেমোরিয়াল হাইস্কুলের ছাত্র সাগ্নিক পেয়েছে ৭১ শতাংশেরও বেশি নম্বর। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সামলে সন্তাদের ওই সাফল্যে তাদের পরিবার থেকে স্কুলের শিক্ষক সকলেই।

যদিও লড়াইটা মোটেও সহজ ছিল না কোনও পরিবারের কাছেই। সাগ্নিকের মা সুপ্রিয়া কুণ্ড সিউড়িরই একটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার শিক্ষিকা। স্বামী গণেশ কুণ্ডু এক সময় বিজ্ঞান বিভাগে পড়ানোর জন্য সিউড়ি শহরের নামকরা গৃহশিক্ষক ছিলেন। এখন সব ফেলে প্রতিবন্ধী ছেলের পাশে থাকেন। দম্পতি জানালেন, ছেলের জন্মের পর থেকে ২৪ দিন তাকে ইনকিউবেটরে রাখতে হয়েছিল। তার পর থেকেই ছেলের অসুস্থতার কথা বুঝতে পারেন ওঁরা। সুপ্রিয়াদেবী বলেন, “আমি চাকরি বজায় রাখলেও সব টিউশন ছেড়ে দিয়ে শুধুমাত্র ছেলের জন্য একটানা লেগে আছে ওর বাবা। সকালে শরীর চর্চা থেকে ছেলের পড়াশোনা। স্কুলে দিয়ে আসা নিয়ে আসা থেকে ঘুমতে যাওয়া পর্যন্ত সর্বক্ষণ শুধু ছেলের পেছনে। পাছে ছেলে কোথাও আঘাত পায়। কারণ, অন্যদের থেকে অনেক ধীর গতিতে কাজ করতে পারে সাগ্নিক। কথাও জড়িয়ে যায়।” যাতে ওর মস্তিস্কে চাপ না পড়ে, সেটা মাথায় রেখে দিনে মাত্র তিন চার ঘণ্টার বেশি পড়াশোনা করার ছাড়পত্র সাগ্নিকের ছিল না। কিন্তু সেই ছেলে নিরাশ করেনি।

অন্য দিকে, অঙ্কিতার বাবা বরুণ সরকার সিউড়িতেই একটি পারিবারিক হোটেল চালান। মেয়ের জন্মের পর এক বছর কেটে গেলেও বসতে না শেখায় সন্দেহ হয়েছিল। এরপর যখন অসুখের কথা জানলেন, তখন দিনরাত এক করে সারাক্ষণ শুধু মেয়েকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন মা সুচিতা সরকার। “মেয়ের পেছনে আমরা না থাকলে আর কে থাকবে?” বললেন সুচিতাদেবী। হোটেল চালানোর পাশাপাশি যেটুকু সময় বাঁচত, তা মেয়ের জন্য রাখতেন বরুণবাবুও। বললেন, “চিকিত্‌সায় সাড়া মিলেছে। তবে মেয়ের হাত কাঁপে। অপরিচিত কাউকে দেখলে কেমন কুঁকড়ে যায়। সচরাচর কথা বলতে চায় না।” এই প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও মেয়েকে নাচ, আঁকা শেখাচ্ছেন ওঁরা। অঙ্কিতা আবার খেলাধুলাতেও পিছিয়ে নেই। প্যারা অলিম্পিকে রাজ্য ও জাতীয় স্তরে ৭টি পদক পেয়েছে সে। এক জন মাত্র শিক্ষকের কাছে পড়েই এই সাফল্য এসেছে ওর। তবে হাত কাঁপে এবং খুব ধীর গতিতে কাজ করতে পারত বলে রাইটার নিয়ে পরীক্ষা দিয়েছিল অঙ্কিতা। তবে রাইটার নেওয়ার ঘোর বিরোধী ছিলেন সাগ্নিকের বাবা গণেশবাবু। সেই জন্য রাইটার ছাড়াই পরীক্ষায় বসেছিল সাগ্নিক। পড়াশোনার পশাপাশি গান খুব প্রিয় সাগ্নিকের। রবীন্দ্র, নজরুল, দ্বিজেন্দ্র, অতুলপ্রসাদের গান এবং পুরানো বাংলা গান শুনতে খুব ভালো লাগে বলে জানিয়েছে সে।

খুব ভাল ফল হয়েছে, এ বার তা হলে কী নিয়ে পড়বে? ঠোঁটের উপর দাঁত চিপে হালকা হাশিতে খুশি ব্যক্ত করলেও কিছু বলেনি অঙ্কিতা। তবে লড়াই যে আগামীতেও চলবে, সেটা দু’জনের শরীরী ভাষাতেই স্পষ্ট। এ দিকে, শুধু সন্তানদের সাফল্য নয়, ওই লড়াইয়ের যাঁরা ওদের সর্বক্ষণের সঙ্গী, সাগ্নিক-অঙ্কিতার বাবা-মায়েরা মানসিক বিকাশে পিছিয়ে থাকা সন্তানদের বাবা-মায়েদের অনুপ্রেরণা জোগাবেন বলেই মত জেলা সর্ব শিক্ষা মিশনের (বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ছাত্র-ছাত্রীদের) জেলা সমন্বায়ক শুকদেব চক্রবর্তী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

ankita sarkar sagnik kundu madhyamik result siuri
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE