হওয়ার কথা ছিল স্কুল। তা কখনওই চালু হয়নি। হয়তো এ বার এই ভবনেই গড়ে উঠবে পলিটেকনিক কলেজ। ছবি: প্রদীপ মাহাতো।
প্রস্তাবিত এলাকা থেকে পলিটেকনিক কলেজ সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সরব হয়েছেন বাঘমুণ্ডির বাসিন্দারা। ওই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে তাঁরা পুরুলিয়ার জেলাশাসকের দ্বারস্থও হয়েছেন। পলিটেকনিক সরানোর সিদ্ধান্তের কথা মেনে নিয়েছেন জেলাশাসক।
পুরুলিয়ার জঙ্গলমহলের ব্লক বাঘমুণ্ডিতে পলিটেকনিক গড়ার সিদ্ধান্ত হয় বাম আমলে। সমস্যা দেখা দেয় জমি নিয়ে। ব্লক সদর লাগোয়া বাঘমুণ্ডি-চড়িদা রাস্তার ধারে খাসজমি পাওয়া গেলেও কলেজে যাওয়ার রাস্তা তৈরির জমি না মেলায় কাজ শুরু করতে দেরি হয়। স্থানীয় কংগ্রেস বিধায়ক নেপাল মাহাতোর উদ্যোগে বাঘমুণ্ডিরই কয়েক জন বাসিন্দা ওই খাসজমি লাগোয়া এলাকায় রাস্তা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় জমি দান করায় সমস্যা মেটে। জমি সমতলের কাজও শুরু হয়। এরই মধ্যে ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচন চলে আসায় গোটা প্রক্রিয়াটাই থমকে যায়।
জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, প্রস্তাবিত জায়গার বদলে অযোধ্যা পাহাড়ের নীচে পুরুলিয়া পাম্পড স্টোরেজ প্রকল্প (পিপিএসপি) এলাকার ভিতরে পলিটেকনিক কলেজ গড়ে তোলা হবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার। যে জায়গায় কলেজ গড়ে উঠবে বলে ঠিক হয়েছে, সেখানে পিপিএসপি-র তরফে আগেই গড়ে তোলা হয়েছে স্কুল, হাসপাতাল বা দমকলের জন্য ভবন। গত এক দশক ধরে বিভিন্ন পর্যায়ে গড়ে তোলা হয়েছে এই ভবনগুলি। কিন্তু, স্কুল, হাসপাতাল বা দমকল, কিছুই চালু হয়নি। বাঘমুণ্ডির বাসিন্দাদের প্রশ্ন, যা হবে বলে ভবনগুলি গড়া হয়েছিল, সে-সব না করে সেখানে কেন পলিটেকনিক কলেজ হবে? তা হলে পলিটেকনিকের জন্য যে জমি রয়েছে, তা কি ফাঁকা পড়ে থাকবে? এলাকার ছেলেমেয়েদের শিক্ষার স্বার্থে ওই কলেজের রাস্তা গড়ার জন্য যাঁরা জমিদান করলেন, তাঁদের মহৎ উদ্দেশ্য কি তা হলে বিফলে যাবে?
বাঘমুণ্ডি পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি, কংগ্রেসের অবনীভূষণ সিংহ বলেন, “আমিও শুনেছি, এ রকম একটা সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে। আমাদের এতে তীব্র আপত্তি আছে। কারণ, যে টুকু জমির জন্য ওই পলিটেকনিক হওয়া আটকে গিয়েছিল, তা দান করার জন্য আমরা এলাকাবাসীকে অনেক বুঝিয়েছি। শেষে কয়েক জন নিঃস্বার্থ ভাবে জমিদান করলেন। এখন তা সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হলে এলাকার মানুষের মনে ক্ষোভ জন্মাবেই।”
এমনিতেই পিপিএসপি কর্তৃপক্ষ যে সমস্ত সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজ করবে বলে কথা দিয়েছিল, সেগুলি আজও করেনি বলে প্রত্যন্ত এই ব্লকের মানুষজনের অভিযোগ। প্রকল্প এলাকার গ্রাম বাড়েরিয়া, খটকাডি, কুদনা, লহরিয়া ও চিটাহি এই সমস্ত গ্রামের বাসিন্দাদের একটা বড় অংশ ‘নেগোশিয়েশন কমিটি’ গড়ে উন্নয়নের কাজ বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলন করছেন দীর্ঘদিন ধরে। ওই কমিটির সম্পাদক মহেন্দ্র মাহাতো বলেন, “বিধি মোতাবেক কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি (সিএসআর) বা সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্প খাতে কিছু কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল পিপিএসপি। প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার পরে প্রশাসনিক কর্তাদের উপস্থিতিতে পিপিএসপি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমাদের একাধিক বৈঠক হয়েছে। সেই বৈঠকগুলির নথি পরীক্ষা করে দেখলেই দেখা যাবে, এলাকার মানুষজন এলাকার উন্নয়নে বারবার একই দাবি পেশ করেছেন।”
মূলত এলাকার রাস্তাঘাটের উন্নয়ন, পানীয় জলের ব্যবস্থা, স্কুল, হাসপাতাল, বাজার, সেচ ব্যবস্থার দাবি করেছিলেন বাসিন্দারা। এ ছাড়া, ছিল স্থানীয় যুবকদের দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ দিয়ে নিয়োগ করা। মহেন্দ্রবাবুর অভিযোগ, বারবার দাবি জানিয়েও কিছু না হওয়ায় ২০০৭ সালে তাঁরা আন্দোলন শুরু করেন। তাঁদের জেলও হয়। কিন্তু, দাবিপূরণ আজও হয়নি। বাড়েরিয়া গ্রামের যুবক প্রশান্ত মাহাতো বলেন, “পিপিএসপি কর্তৃপক্ষ কিছুই করেনি, এমন নয়। বাজার-স্কুল-হাসপাতাল তৈরি করেছে, দমকল কেন্দ্রও হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে ভবনগুলি তৈরি হয়ে পড়ে আছে। সাধারণ মানুষের কোনও কাজেই সে-সব আসেনি।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাঘমুণ্ডির কিছু বাসিন্দার ক্ষোভ, “এখন আমরা শুনছি, প্রকল্প এলাকার মধ্যে স্কুল বা হাসপাতাল চালু করার জন্য যে সমস্ত ভবন নির্মাণ করা রয়েছে, সেখানে পলিটেকনিক চালু করা হবে। সে ক্ষেত্রে এলাকা একটি স্কুল বা হাসপাতাল থেকে বঞ্চিত হবে। অথচ পলিটেকনিক গড়ার জন্য তো জমি পড়ে রয়েছে!” সম্প্রতি এলাকার কিছু বাসিন্দা জেলাশাসকের সঙ্গে দেখা করে পলিটেকনিক সরানো নিয়ে তাঁদের আপত্তির কথা জানিয়েছেন।
লোকসভা নিবার্চনের আগে এ নিয়ে সরব হয়েছে ফরওয়ার্ড ব্লক এবং কংগ্রেস। পুরুলিয়ার সাংসদ নরহরি মাহাতো বলেন, “সরকার যে পিপিএসপি প্রকল্প এলাকার ভিতরে পলিটেকনিক গড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা আমরা জেনেছি। আমাদের দাবি, ওখানে যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান গড়ার কথা, তা আগে গড়ে তোলা হোক। পলিটেকনিক যেখানে হওয়ার সেখানেই করা হোক। আমরা এনিয়ে আন্দোলনে নামব।” জেলা কংগ্রেস সভাপতি তথা বাঘমুণ্ডির বিধায়ক নেপাল মাহাতো বলেন, “সরকার কেন এ রকম সিদ্ধান্ত নিল, তা আমরা বিধানসভায় জানতে চাইব। জেলাশাসকের সঙ্গে দেখা করে আমাদের প্রতিবাদও জানাব। প্রয়োজনে কংগ্রেস আন্দোলনে নামবে।”
পিপিএসপি-র বাঘুমণ্ডির প্রকল্প আধিকারিক তরুণকুমার মিত্র বলেন, “এ নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। এটা সরকারের সিদ্ধান্ত।” জেলাশাসক তন্ময় চক্রবর্তী বলেন, “এ রকম একটি সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে। তবে ওই প্রকল্প এলাকার মধ্যে একাধিক ভবন নির্মাণ হয়ে পড়ে রয়েছে। এখানে পলিটেকনিক চালু হলে হাসপাতাল বা স্কুল গড়া যাবে না, তা নয়।” তিনি আরও জানিয়েছেন, যে জমিতে পলিটেকনিক হওয়ার কথা, সেখানে রাজ্য শিক্ষা দফতরের উদ্যোগে ইন্টিগ্রেটেড স্কুল গড়ে তোলা হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy