Advertisement
E-Paper

বেকারদের দিশা দেখাচ্ছেন বিডিও

কী করে একটা সরকারি চাকরি জুটবে, তারই চিন্তায় রাত জাগেন না দক্ষিণ দুর্গাপুরের নাসরিন খাতুন। উজ্জ্বলপুরের রাধারানি পাল কিংবা ময়ূরেশ্বরের পুকুরপাড়ার কমলেন্দু বিশ্বাসরাও এখন আর মানসিক অবসাদে ভোগেন না। আবার বেঁচে থাকার অর্থটাই বদলে গিয়েছে লাভপুরের সুপ্রিয়া দত্তদের। ন’মাসের মধ্যেই এঁদের সবার দৃষ্টিভঙ্গিটাই বদলে দিয়েছেন লাভপুরের বিডিও জীবনকৃষ্ণ বিশ্বাস।

অর্ঘ্য ঘোষ

শেষ আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:৩৭
চলছে ‘বিডিও স্যারে’র ক্লাস। ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি।

চলছে ‘বিডিও স্যারে’র ক্লাস। ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি।

কী করে একটা সরকারি চাকরি জুটবে, তারই চিন্তায় রাত জাগেন না দক্ষিণ দুর্গাপুরের নাসরিন খাতুন। উজ্জ্বলপুরের রাধারানি পাল কিংবা ময়ূরেশ্বরের পুকুরপাড়ার কমলেন্দু বিশ্বাসরাও এখন আর মানসিক অবসাদে ভোগেন না। আবার বেঁচে থাকার অর্থটাই বদলে গিয়েছে লাভপুরের সুপ্রিয়া দত্তদের। ন’মাসের মধ্যেই এঁদের সবার দৃষ্টিভঙ্গিটাই বদলে দিয়েছেন লাভপুরের বিডিও জীবনকৃষ্ণ বিশ্বাস।

শুনতে গল্পের মতো হলেও, শুধু নাসরিন কিংবা কমলেন্দুরাই নন, দলে দলে বেকার যুবক-যুবতী জীবনবাবুর পরামর্শ এবং প্রশিক্ষণে জীবনে নতুন দিশা খুঁজে পেয়েছেন। অথচ এক সময় নিজেদের আর কিছু হবে না বলে ধরেই নিয়েছিলেন তাঁরা। হতাশার চোরাবালি সরিয়ে এখন তাঁরাই কিছু করার স্বপ্নে বিভোর। জীবনবাবুর নিজের কথায়, “চাকরির নাগাল না পেতে পেতে অনেকেই নিজেদের কোনও কাজের নয় ভেবে, মানসিক অবসাদের শিকার হয়ে পড়েন। ওই সব যুবক-যুবতীরা যাতে মনোবল ফিরে পেয়ে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হতে পারেন, তার জন্যই এই উদ্যোগ।”

কিন্তু, বিডিও-র দায়িত্ব সামলে কীভাবে প্রশিক্ষণের জন্য সময় বের করেন জীবনবাবু? জানা গেল, অন্য আর পাঁচ জন বিডিও-র মতোই তাঁরও কাজের কমতি নেই। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ধমক যেমন আছে, অধীনস্থ পঞ্চায়েত প্রধানদের গুঁতোও রয়েছে। এমনকী, রয়েছে শাসকদলের নেতাদের খবরদারিও। কিন্তু, যা নেই তা হল, তাঁর রবিবারের ছুটি। রবিবারেও তাঁকে সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৩টে পর্যন্ত টানা ব্যস্ত থাকেন জীবনবাবু। কারণ, ওই সময়ই তিনি বিনাপারিশ্রমিকে অবসাদগ্রস্থ ওই বেকার যুবক-যুবতীদের আত্মবিশ্বাস ফেরানোর দায়িত্ব নিয়েছেন। তবে, নিছক তাত্ত্বিক উপদেশ দিয়ে নয়, বাস্তবিক অর্থেই চলার পথ দেখাচ্ছেন তিনি।

জীবনবাবুর দেখানো পথে হেঁটে জীবনের নতুন অর্থ খুঁজে পেয়েছেন, তেমন একজন লাভপুরের দক্ষিণ দুর্গাপুরের নাসরিন খাতুন। নাসরিনের বাবা মারা গিয়েছেন দীর্ঘদিন আগে। খোঁজ নেই মায়ের। কীর্ণাহার বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষিকাদের সহযোগিতায় ২০১১ সালে স্নাতক পাশ করেও কোনও চাকরি মেলেনি নাসরিনের। টিউশনি করে আর বিড়ি বেঁধে তিন ভাইবোনের সংসার চালাতে হতো তাঁকে। সেই নাসরিনই একদিন হতাশায় ভেঙে পড়ে জীবনবাবুর কাছে ঋণ বা সরকারি অনুদান নয়, যে কোনও একটি চাকরি চেয়ে বসেন। ঘটনাচক্রে, ২০১৩ সালের অগস্ট মাসে, সে দিনই প্রথম লাভপুরের বিডিও হিসাবে যোগ দেন জীবনবাবু।

উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁয় জীবনবাবুর বাড়ি। বাবা জগবন্ধু বিশ্বাস অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক। বিভিন্ন সরকারি দফতরে কাজ করার পরে জীবনবাবু লাভপুরে বিডিও হিসেবে যোগ দেন। শুধু নাসরিনই নয়, প্রায় প্রতি দিনই কেউ না কেউ এসে তাঁর কাছে চাকরির দাবি জানাতেন। যাঁদের মধ্যে অধিকাংশই বেকারত্বের জ্বালায় মানসিক অবসাদের শিকার। অনেকেই তাঁকে এমনও জানান, ‘চাকরি না পেলে আত্মহত্যা করা ছাড়া কোনও উপায় নেই!’

কার্যত বেকার যুবক-যুবতীদের ওই কথা শুনে আরও বিড়ম্বনায় পড়েন লাভপুরের বিডিও। তিনি তাঁদের বারবার বলেও বোঝাতে পারেননি, বিডিও-র হাতে সব কিছু করে দেওয়ার মতো ক্ষমতা নেই। বাধ্য হয়েই তিনি তাঁদের নাম-ঠিকানা লিখে নেন। চাকরি পাওয়ার পথ খুঁজে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আশ্বস্ত করেন। সেই থেকে শুরু হয় জীবনবাবুর পথ খোঁজা। এক দিন তিনি ওই যুবক-যুবতীদের ডেকে সাফ জানিয়ে দেন, ‘চাকরি করে দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। কিন্তু তোমরা চাইলে, আমি চাকরি পাওয়ার পথ দেখাতে পারি। বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক চাকরির পরীক্ষায় বসার জন্য প্রশিক্ষণ নিয়ে। নিজেকে যোগ্য ভাবে তৈরি করো। আমি তোমাদের সেই প্রশিক্ষণ দিতে পারি।’

বস্তুত, বিডিও-র মুখে ওই কথা শুনে অবাক হয়ে যান যুবক-যুবতীরা। তাঁরা তাঁদের অভিজ্ঞতায়, টেবিলে বসে বিডিও-দের কলম পিষতে দেখেছেন। কিংবা কোনও অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে শুনেছেন। বিডিও চাকরির প্রশিক্ষণ দেবেন, সেটাই যেন বিশ্বাস করে উঠতে পারছিলেন না তাঁরা। শেষ পর্যন্ত ২০ জনকে নিয়ে দফতরেরই এক সভাকক্ষে জীবনবাবু শুরু করেন ক্লাস। এখন লাভপুরের পরিধি ছাড়িয়ে জেলার অন্যান্য ব্লক এমনকী লাগোয়া মুর্শিদাবাদ থেকেও বেকারেরা নাম লেখাচ্ছেন সেই ক্লাসে। সব মিলিয়ে এখন শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১১৫ জন!

কয়েক মাস ক্লাস করেই মনোবল ফিরে পেয়েছেন উজ্জ্বলপুরের রাধারানি পাল, লাভপুরের সুপ্রিয়া দত্ত, ময়ূরেশ্বরের পুকুরপাড়ার কমলেন্দু বিশ্বাসরা। সে কথাই বলছিলেন তাঁরা। প্রতিবন্ধী বাবা কাগজের ঠোঙা তৈরি করে পড়ার খরচ জুুগিয়েছেন রাধারানির। ২০০৫ সালে বিএ পাশ করেও বেকার। যেমন চাকরি নেই ২০১৪ সালে এমএসসি পাশ করে চা-বিক্রেতার মেয়ে সুপ্রিয়ার। অথবা, ২০১১ সালে বিএ পাশ করা কমলেন্দুর। মায়ের বালাপোশ তৈরির আয়েই সংসার চলে তাঁর। বিডিও সাহেবের ক্লাস করার অভিজ্ঞতা থেকে বলছিলেন, “আমাদের প্রভাবশালী মামা-কাকা নেই। তাই কোনও চাকরি জোটেনি। ধরেই নিয়েছিলাম আমাদের আর কিছু হবে না। সব সময় মানসিক অবসাদে ভুগতাম। বিডিও স্যার আমাদের ধারণা বদলে দিয়েছেন। তাঁর কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে মনে হচ্ছে, আমরাও কিছু করতে পারি। শুধু প্রশিক্ষণই নয়, স্যার আমাদের প্রয়োজনীয় বইপত্রও দেন।”

এখানেই থেমে নেই জীবনবাবুর উদ্যোগ। নতুন বছর থেকেই অধীনস্থ ১১টি পঞ্চায়েতেও খোলা হচ্ছে প্রবেশিকা প্রশিক্ষণ ক্লাস। সেখানে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ ছেলেমেয়েদের সপ্তাহে এক দিন স্বেচ্ছাশ্রমে প্রশিক্ষণ দেবেন জীবনবাবুর শিক্ষার্থীরা। মাঝে মধ্যে ওই সব প্রশিক্ষণকেন্দ্র তিনি নিজেও পরিদর্শনে যাবেন। তিনি বলেন, “উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পরে ছেলেমেয়েরা পরবর্তী কর্মজীবন সম্পর্কে দিশাহারা হয়ে না পরে, সেই লক্ষ্যেই তাঁদের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত করতে পঞ্চায়েত স্তরের ওই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের আয়োজন।”

ছুটির দিনে বিডিও-র এমন কর্মকাণ্ডকে কেমন চোখে দেখেন তাঁর পরিবার?

বিডিও-র কোয়ার্টারেই ৬ বছরের ছেলে জ্যোতিষ্ককে নিয়ে থাকেন স্ত্রী মুনমুনদেবী। তিনি বলেন, “ব্লকের কাজ সামলে এক জন বিডিও-র হাতে পরিবারকে দেওয়ার মতো সময় কমই থাকে। উনি রবিবারেও প্রশিক্ষণে ব্যস্ত থাকেন। অভিমান হয় ঠিকই! কিন্তু ছেলেমেয়েগুলোর মুখে যখন শুনি ‘স্যারের জন্য আমরা নতুন করে কিছু ভাবতে পারছি’, তখন সব অভিমান মিথ্যে মনে হয়!”

job trainning bdo arghya ghosh labhpur
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy