নানুরের উকরুন্দি গ্রামে ভোজন। —নিজস্ব চিত্র।
এক সময় গ্রামে গ্রামে ভিক্ষা করে মহোৎসবের আয়োজন করেছিলেন এক বৈষব সাধক। সেই মহোৎসব চালু রাখতে মাঠ পাহারার টাকা দিলেন গ্রামের মানুষ। এমনই দৃশ্য দেখা গেল নানুরের উকরুন্দি গ্রামে।
স্থানীয় সূত্রেই জানা গিয়েছে, প্রায় ৩০০ বছর আগে দীনবন্ধু দাস নামে এক বৈষ্ণব আখড়া খোলেন। পরবর্তীকালে গোঁসাইবাবা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন তিনি। তাঁর আখড়াস্থলটি গোঁসাইবাবার পাড় হিসেবে পরিচিত হয়। প্রচলিত আছে, গোঁসাইবাবা তার ভক্তদের নিয়ে ১লা মাঘ মহোৎসবের আয়োজন করেন। তখন তাঁর সম্বল বলতে ছিল ভিক্ষা করে সংগৃহিত চাল-ডাল। ক্রমে অন্য গ্রামবাসীরাও ওই মহোৎসবে যোগ দিতে শুরু করেন। ভিক্ষায় সংগৃহিত চাল-ডালে আর সব দিক সঙ্কুলান অসম্ভব হয়ে পড়ে। তখন গোঁসাইবাবার শিষ্যরা এক অভিনব উপায় বের করেন। গ্রামবাসীদের তাঁরা জানান, ১ লা মাঘ তাঁদের বাড়িতে রান্না করতে হবে না। পরিবর্তে বাড়িতে রান্না খরচের কিছুটা অংশ তাঁরা তুলে দেবেন মহোৎসবের জন্য। ওই দিন সকাল থেকে পাতা থাকবে একটি চাদর। গ্রামবাসীরা তাতে যার যেমন সামর্থ রেখে যাবেন। ওই আখড়ার সেবাইত ৮২ বছরের নিতাই মহান্ত জানান, বাপ-ঠাকুরদার মুখে শুনেছি ওই প্রস্তাবে ভালই সাড়া মেলে।
বছর কুড়ি আগে পর্যন্ত এই ব্যবস্থাতে ভালই চলছিল। কিন্তু মহোৎসবে যোগদানের পরিধি বাড়ে। দূরদূরান্তের মানুষজনও সামিল হতে শুরু করেন। মহোৎসব বন্ধ হওয়ার উপক্রম দেখা দেয়। তখন এগিয়ে আসেন স্থানীয় শিবকালী যুব সমিতি। মাঠ পাহারা দিয়ে পাওয়া ধান বিক্রির টাকা তাঁরা তুলে দেন উদ্যোক্তাদের হাতে। পরবর্তীকালে মহোৎসবের যাবতীয় দায়ও তাঁরা তুলে নেন নিজেদের কাঁধে। ক্লাবের সভাপতি পরমারঞ্জন পাল, সম্পাদক পার্থসারথি মণ্ডল বলেন, “দূর-দূরান্তের মানুষের যোগদান বৃদ্ধি পাচ্ছে। বহিরাগত ওই সব মানুষেরা আমাদের কাছে অতিথির মতো। তাঁদের কাছে কিছু নেওয়াটা ভাল দেখায় না। তাই মাঠ পাহারার টাকাই মহোৎসবে লাগানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।” অন্যতম উদ্যোক্তা জীবন পাল, কিশোর রুদ্রদের কথায়, “এক জন ভিক্ষাজীবী বৈষ্ণব একত্র ভোজনের মহৎ উদ্দেশ্য যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন তাকে মর্যাদা দিতেই আমরা ওই মহোৎসবের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছি।”
গোঁসাইবাবা প্রয়াত হয়েছেন দীর্ঘকাল আগে। তারপর চালু হয়েছে ১ দিনের মেলাও। মহোৎসবের পাশাপাশি সেই মেলাও আজ সমান জনপ্রিয় এলাকার মানুষের কাছে। সুভদ্রা প্রামাণিক, চণ্ডীচরণ পাণ্ডা বললেন, ‘প্রতিবছর এই দিনটাতে গ্রামের অধিকাংশ বাড়িতেই রান্না হয় না। মেলা দেখতে আসা আত্মীয়স্বজনও সামিল হন মহোৎসবে।” উদ্যোক্তারা জানান, এ বারে প্রায় ৫০০০ মানুষ সামিল হয়েছেন। আয়োজন সামান্যই। খিচুড়ি, বাঁধাকপির তরকারি আর টক। তাই খেয়েই চোখে মুখে পরিতৃপ্তির ঝিলিক লাভপুরে ইন্দাসের বিশ্বেশ্বরী মণ্ডল, উকরুন্দির দু’কড়ি ঘোষদের। তাঁরা বলেন, “একসঙ্গে বসে খাওয়ার মজাটাই আলাদা।” আর ছোটরা? হাতে বেলুন, বাঁশি কিংবা নাগরদোলার হাতল ধরে পঞ্চম শ্রেণির স্বপন মণ্ডল, ষষ্ঠ শ্রেণির চুমকি ঘোষরা বলে, “গোঁসাইদাদুকে ধন্যবাদ। তাঁকে উপলক্ষ করেই তো মেলাটা বসিয়েছিলেন বাবা-কাকারা। তাই তো আমরা এত আনন্দ করতে পারছি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy