Advertisement
E-Paper

মকর স্নানের ভিড় দুই জেলায় পিঠে খেয়েই মেলা, সিনেমায় ছুট

কোথাও তুষু, কোথাও টুসু। এলাকা অনুযায়ী বানানে ভিন্নতা থাকলেও মকর সংক্রান্তির সকালে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া দুই জেলার নদী ও জলাশয়ের পাড়ে চৌডল নিয়ে মানুষের ভিড়ের কোনও আলাদা ছবি ছিল না। আট থেকে আশি সবার সমান উত্‌সাহ দেখা গেল। দিনভর মেলায় মেলায় হইহুল্লোড়ে মেতে থাকলেন সকলে।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:২৯

কোথাও তুষু, কোথাও টুসু। এলাকা অনুযায়ী বানানে ভিন্নতা থাকলেও মকর সংক্রান্তির সকালে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া দুই জেলার নদী ও জলাশয়ের পাড়ে চৌডল নিয়ে মানুষের ভিড়ের কোনও আলাদা ছবি ছিল না। আট থেকে আশি সবার সমান উত্‌সাহ দেখা গেল। দিনভর মেলায় মেলায় হইহুল্লোড়ে মেতে থাকলেন সকলে।

‘তষলা গো রাই/ তোমার সিনানে আমরা মাকড়ি পিঠা খাই’।

তুষু গানের এই প্রাচীন কলি বৃহস্পতিবার ভোর থেকে ভেসে বেড়ালো বিষ্ণুপুরের যমুনাবাঁধ, দ্বারকেশ্বর ও বিড়াই নদের পাড়ে। বরাবরের মতো তুষু ভাসানের পরে স্নান সেরে মাকড়ি পিঠা খাওয়ার ধুমও দেখা গেল গাঁয়ে গাঁয়ে। পুরুলিয়ার কংসাবতী, সুবর্ণরেখা, দ্বারকেশ্বর, শিলাবতী, টটকো নদীর সঙ্গে কয়রাবেড়া, মুরগুমা, লহরিয়া, ফুটিয়ারি, ইন্দ্রবিল, বড়ন্তি, দোলাডাঙা, হনুমাতা-সহ বিভিন্ন জলাধারের পাড়েও চৌডল ভাসাতে কাতারে কাতারে মহিলারা ভিড় করেছিলেন। তুষুর মেলাতে মানুষজনের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো।

বিষ্ণুপুরে শোলার ভেলা হাতে গান গাইতে গাইতে যাচ্ছিলেন। শোলার ভেলায় বসানো তুষের ভাঁড়, চারপাশে গাঁদা ফুলের মালা। সেই ভেলায় ঝুলছিল জিলিপি। রানি ও পতি বাউরিরা গাইছিলেন ‘চল তুষু চল নাইতে যাবো/ যমুনাবাঁধের গাছতলায়’। এ দিন ভোর থেকে কৃষ্ণগঞ্জ এলাকার যমুনাবাঁধের রাস্তায় রীতিমতো চৌডল মাথায় লাইন পড়ে গিয়েছিল। মহিলারা জানান, একমাস তাঁরা বাড়িতে তুষুব্রত পালন করার পরে এ দিন তুষু ভাসাতে এসেছেন। বিষ্ণুপুর শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার ছাড়িয়ে দ্বারকেশ্বর নদের তীরে ষাঁড়েশ্বরের মন্দির চত্বরে ভেলা ভাসানোকে কেন্দ্র করে মেলা বসেছে। পাশের অযোধ্যা, জয়কৃষ্ণপুর, মুণিনগর, জন্তা, অবন্তিকা গ্রাম থেকে আসা মানুষের ঢল ছিল সেখানে।

তুষুর চৌডল বিসর্জনের পরে বাঁকুড়া জেলার অন্যত্রও মেলায় মাতোয়ারা হলেন কচিকাঁচা, তরুণ-তরুণী থেকে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা। কোথাও নদী তীরে, আবার কোথাও বাঁধে বা দিঘিতে পূণ্যস্নান সারলেন এলাকাবাসী। মকর সংক্রান্তি উপলক্ষে এ দিন ভোর থেকেই দক্ষিণ বাঁকুড়ার কংসাবতী, কুমারী, শীলাবতী, দ্বারকেশ্বর, জয়পণ্ডা থেকে উত্তর বাঁকুড়ার গন্ধেশ্বরী ও শালি নদীর ঘাটে ঘাটে টুসুর চৌডল ভাসিয়ে পূর্ন্যস্নানে নেমে পড়েন এলাকার মানুষজন।

কংসাবতীর তীরে খাতড়ার পরকুলে, মুকুটমণিপুর জলাধার লাগোয়া রানিবাঁধের পরেশনাথ মন্দিরে এ দিন মেলা বসেছিল। সিমলাপালের আনন্দপুরে শিলাবতী নদী তীরবর্তী এলাকায় এ দিন থেকেই শুরু হয়েছে গঙ্গামেলা। এ বার এই মেলা ২২ বছরে পা দিল। মেলা কমিটির তরফে জানানো হয়েছে, সাতদিন ধরে মেলা চলবে। হিড়বাঁধের মলিয়ানে শতাব্দী প্রাচীন মাকড়া মেলা, ইন্দাসে বাঁকুড়া রায় জিউয়ের কুড়চি মেলা, সোমসার মেলা এ দিন থেকেই শুরু হয়েছে। বাঁকুড়ার গন্ধেশ্বরী নদীতে, তালড্যাংরার জয়পণ্ডা নদীর ঘাটে, বড়জোড়া, সোনামুখী, পাত্রসায়রের শালি নদীতে এ দিন ভোর থেকেই স্নান সারতে নেমে পড়েন বহু মানুষ। মেলার পাশাপাশি নদীর তীরে চড়ুইভাতির আসর বসে বেশকিছু এলাকায়।

বছর চারেক আগেও মাওবাদী আতঙ্কে কিছুটা হলেও টুসু পরব মিয়ম্রান হয়ে পড়েছিল দক্ষিণ বাঁকুড়ার জঙ্গলমহলে। ২০১১ সাল থেকেই অবশ্য ছবিটা বদলে গিয়েছে। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

এ দিন ভোর থেকেই জঙ্গলমহলের গ্রাম লাগোয়া নদীতে স্নান সেরে মেলায় হাজির হন সকলে। মেলায় বিকিকিনির হাটের মাঝে পিকনিক করেন অনেকেই। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভিড় বাড়ে পরেশনাথ, পরকুল ও গঙ্গামেলায়। সিমলাপালে গঙ্গামেলা দেখতে আসা খাতড়ার সাবুবাইদ গ্রামের বাসিন্দা অনুপ পাত্র বললেন, “শিলাবতীতে মকর স্নান করে নদীর ধারে পিকনিক করলাম। মেলাও দেখলাম। পরে সিমলাপাল উত্‌সবেও ঘুরে এলাম। একই সঙ্গে কত উত্‌সব। সারাটা দিন আমাদের হইহুল্লোড় করে কেটে গেল। সিমলাপালের বধূ সুজাতা সিংহ মহাপাত্র বলেন, “এই দিনটার জন্য বছরভর অপেক্ষা করি। নদীতে স্নান সেরে মেলা দেখলাম, নাগরদোলায় ঘুরলাম, অনেক মজা হল।

পৌষ সংক্রান্তির দিনে কনকনে শীতে উপেক্ষা করে মানুষের ঢল নামল পুরুলিয়ার জেলার বিভিন্ন টুসু মেলায়। আলো ফোটার আগে থেকেই বিভিন্ন জলাধারের পাড়ে ভিড় করেন মানুষজন। টুসুগানে ভরে ওঠে ভোরের নদীর তীর। সুবর্ণরেখার তীরে তুলিন, কংসাবতীর তীরে মহাদেববেড়া বা মন্দির ক্ষেত্র দেউলঘাটায় এ দিন ভিড় উপচে পড়েছে। বিভিন্ন আখড়ায় আগুন জ্বেলে টুসুগানের সঙ্গে এ বার মুখরিত হয়েছে বাউলের সুরও।

এক দিকে যেমন জেলার বিভিন্ন প্রান্তের মেলায় থিকথিক করেছে ভিড়, তেমনই পুরুলিয়া শহরের রাস্তাঘাট এ দিন সকাল থেকেই ছিল ফাঁকা। জেলার বেশিরভাগ রুটেই বেসরকারি বাস পথেই নামেনি।

কংসাবতীর তীরে মহাদেববেড়া ঘাটে টুসু বিসর্জন দিতে এসে জামবাদ গ্রামের বধূ মেঘনা মাহাতো, সমাপ্তি মাহাতো বললেন, “টুসু আমাদের প্রাণের উত্‌সব। মেলায় আগের মতোই ভিড় আছে, কিন্তু সেই টান এখন আর সবার মধ্যে দেখতে পাচ্ছি না। এখন মেলায় এলেও সবাই আর গান গায় না। নতুন প্রজন্মের অনেকে আর গাইছেন না।”

টুসুর সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে পিঠে-পার্বণ। বাড়িতে যেমন পিঠে খাওয়া, তেমনই পিঠে খাওয়ার নিমন্ত্রণও কম নয়। পিঠের নামও কতরকমের— গ্যাঁড়গেড়া, মাকড়ি প্রভৃতি। খেজুর গুড়ে ডুবিয়ে মকর সংক্রান্তিতে সেই পিঠে খাওয়াই মজলেন দুই জেলার বাসিন্দারা। বুধবার রাতভর বিভিন্ন বাড়িতে এক দিকে হয়েছে তুষু জাগরণ, অন্য দিকে চালগুঁড়ির পিঠে। পায়েস তৈরি হয়েছে। বিষ্ণুপুরের তেজপালের বাসিন্দা টুম্পা লোহার, মলডাঙার ভারতী দত্ত বলেন, “মকর মানেই আমাদের কাছে পিঠে পরব। সেই পিঠে তৈরিতেই বুধবার অনেক রাত হয়ে গেল।”

বহু বাড়িতেই এ দিন রান্নাবান্নাও ছিল না। বিকেলের দিকে সপরিবারে অনেকেই কাছেপিছে বেড়াতে গেলেন। বিষ্ণুপুরের লালগড়, রাসমঞ্চ, জোড়বাংলা, শ্যামরাই ও মদনমোহন মন্দির প্রাঙ্গণে ভিড় দেখা গেল। রামসাগরের বাসিন্দা সুবোধ রায় রাসমঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন, “কত দূরের মানুষজন মন্দির দেখতে এখানে বেড়াতে আসেন। পিঠে-পার্বণে বাড়িতে দুপুরের কাজ কম। তাই স্ত্রীকে নিয়েই ঘুরতে বেড়িয়েছি।”

সিনেমা হলেও ভিড় ছিল। দুপুরে বিষ্ণুপুরের একটি সিনেমা হলের সামনে দেখা গেল এই শহরের বাসিন্দা অপর্ণা ও রহিত দাসকে। তাঁরাও জানালেন, “হলে এসে সিনেমা তো প্রায় দেখাই হয় না। এ দিন ফুরসত্‌ পেয়ে পিঠে খেয়ে বেড়িয়ে পড়লাম।”

makar sankranti
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy