Advertisement
১৯ মে ২০২৪

রেশনে উধাও গম, ভোটের জন্য তদন্তে বিলম্ব

গরিবের জন্য বরাদ্দ ২০ হাজার কুইন্টাল গম উধাও হয়ে গিয়েছে। ফলে বীরভূমের প্রায় সাত লক্ষ বিপিএল গ্রাহক এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে রেশন থেকে আটা পেলেন না। বিষয়টি নিয়ে খাদ্য দফতরে অভিযোগ জমা পড়েছে। অভিযোগ জমা পড়েছে দুর্নীতি দমন শাখা এবং মুখ্যমন্ত্রীর দফতরেও। তবে নির্বাচন মরসুমে কর্মী না থাকায় অভিযোগের তদন্ত শুরু করা যায়নি। খাদ্য দফতরের এক কর্তা বলেন, “অভিযোগ পেয়েছি। খুব শীঘ্রই তদন্ত শুরু করা হবে।” বিপিএলদের জন্য বরাদ্দ গম বাজারে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে কিনা, তা-ও খতিয়ে দেখা হবে, জানিয়েছেন ওই কর্তা।

মান নিয়েই প্রশ্ন। —ফাইল চিত্র।

মান নিয়েই প্রশ্ন। —ফাইল চিত্র।

অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়
বীরভূম শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০১৪ ০১:১৪
Share: Save:

গরিবের জন্য বরাদ্দ ২০ হাজার কুইন্টাল গম উধাও হয়ে গিয়েছে। ফলে বীরভূমের প্রায় সাত লক্ষ বিপিএল গ্রাহক এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে রেশন থেকে আটা পেলেন না। বিষয়টি নিয়ে খাদ্য দফতরে অভিযোগ জমা পড়েছে। অভিযোগ জমা পড়েছে দুর্নীতি দমন শাখা এবং মুখ্যমন্ত্রীর দফতরেও। তবে নির্বাচন মরসুমে কর্মী না থাকায় অভিযোগের তদন্ত শুরু করা যায়নি। খাদ্য দফতরের এক কর্তা বলেন, “অভিযোগ পেয়েছি। খুব শীঘ্রই তদন্ত শুরু করা হবে।” বিপিএলদের জন্য বরাদ্দ গম বাজারে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে কিনা, তা-ও খতিয়ে দেখা হবে, জানিয়েছেন ওই কর্তা।

কী করে উধাও হল আটা? এ বিষয়ে ফুড কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া (এফসিআই) আর খাদ্য দফতর পরস্পরের উপর দোষ চাপাচ্ছে। এফসিআইয়ের বর্ধমান ও বীরভূম জেলার এরিয়া ম্যানেজার রবি যাদব বলেন, “আমরা সরকারকে সময় মতো গমের জোগান দিয়েছি। এর পর কী হয়েছে, তা জেলার খাদ্য সরবরাহ দফতরের নিয়ামক বলতে পারবেন।” বীরভূম জেলা খাদ্য সরবরাহ নিয়ামক বাপ্পাদিত্য চন্দ্র বলেন, “সময় মতো গম না পাওয়ার জন্য এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে আটা দেওয়া যায়নি।”

খাদ্য সরবরাহ দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রতি জেলাতে দারিদ্র সীমার নীচে বসবাসকারীদের জন্য রেশনে ৭৫০ গ্রাম প্যাকেট আটা ৬ টাকা দরে দেওয়া হয়। বীরভূম জেলার জন্য প্রতি মাসে এফসিআই থেকে প্রায় কুড়ি হাজার কুইন্টাল গম নিয়ে খাদ্য সরবরাহ দফতর তা সরকার-নির্ধারিত মিল মালিকদের জোগান দেয়। সেখান থেকে ডিস্ট্রিবিউটররা আটা নিয়ে ডিলারদের সরবরাহ করেন। ডিলারদের কাছ থেকে গ্রাহকেরা তা সংগ্রহ করেন। এ ক্ষেত্রে অভিযোগ উঠেছে, এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে এফসিআই থেকে গম নিয়েছে খাদ্য দফতর। কিন্তু জেলায় দারিদ্র সীমার নীচে বসবাসকারী ৬ লক্ষ ৯৯ হাজার ৮০৪ জন তাঁদের বরাদ্দ আটা পাননি। যাঁদের মধ্যে অনেকেই আদিবাসী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ।

খাদ্য দফতরের কাছে দায়ের করা অভিযোগে বলা হয়েছে, বীরভূমের মল্লারপুর, দুবরাজপুর, লাভপুর এবং বোলপুর এলাকায় গম থেকে আটা প্রস্তুত করার জন্য সরকার মল্লারপুরের একটি মিলকে বরাত দিয়েছে। এফসিআইয়ের বরাদ্দ গম সেখানেই যাওয়ার কথা। ওই আটা প্রস্তুতকারী মিল থেকেই বীরভূম জেলার বেশির ভাগ রেশন দোকানে প্যাকেটে আটা জোগান দেওয়া হয়। মল্লারপুরের সেই মিলের মালিক তন্ময় রায় অবশ্য গম পাওয়ার কথাই অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, “এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে ঠিক সময়ে গম না পাওয়ার জন্য আটা জোগান দেওয়া যায়নি।” তবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় সপ্তাহে আটা দেওয়া হয়েছে। তা হলে প্রথম সপ্তাহের বরাদ্দের কী হবে? বাপ্পাদিত্যবাবুর আশ্বাস, প্রথম সপ্তাহের বরাদ্দ আটা চতুর্থ সপ্তাহের সঙ্গে যোগ করে দেওয়া হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন বাপ্পাদিত্যবাবু। রাজনগর ব্লকের চন্দ্রপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের কানাইপুর গ্রামের বাসিন্দা পটল মুর্মু, হারা হেমব্রমরা অবশ্য তাতে খুশি নন। তাঁরা জানিয়েছেন, আটা না পাওয়ার জন্য অনেকেরই খুব অসুবিধে হয়েছে। ওই আটা কবে পাওয়া যাবে, তা-ও রেশন দোকানে তাঁরা জানতে পারেননি।

কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, গাফিলতি কার? এফসিআই-এর থেকে কি গম মিলেছে দেরিতে? নাকি, গম সময়মতো আসার পরেও, তা উধাও হয়ে গিয়েছে? খাদ্য দফতরের এক অফিসার বলেন, “একটি চক্র গম পাচারে সামিল রয়েছে বলে দফতরে অভিযোগ জমা পড়েছে। শীর্ষ কর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে তাঁরা এই কাজ করছে।” এই সময়ে বাজারে গমের দাম বেশি। তাই এফসিআই-এর গম বাজারে বিক্রি করে, পরে কমদামি গম কিনে রেশনে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না কর্তারা।

এই অভিযোগ আরও গুরুত্ব পেয়েছে, কারণ আটার মান নিয়ে অনেক দিন ধরেই অভিযোগ উঠছিল। এফসিআই উন্নত মানের গম সরবরাহ করলেও অনেক সময়ে আটা মিলে তা বজায় থাকছে না, এমন বেশ কিছু অভিযোগ ইতিমধ্যেই জমা পড়েছে। একই অভিযোগ উঠেছে চাল নিয়েও। বিশেষত বীরভূমের আদিবাসী অধ্যুষিত সাতটি ব্লকে বিপিএল পরিবারগুলির মধ্যে রেশনে ২ টাকা কেজি দরে প্রতি সপ্তাহে দু’কিলোগ্রাম যে চাল দেওয়া হচ্ছে, তা অত্যন্ত নিম্ন মানের বলে অভিযোগ উঠেছে। দুবরাজপুর, রাজনগর, খয়রাশোল, মহম্মদবাজার, রামপুরহাট ১, নলহাটি ১, মুরারই ১ ব্লকে আদিবাসী পরিবারগুলি বিষয়টি নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন।

রাজনগর গ্রাম পঞ্চায়েতের শঙ্করপুর, বাবুজোর সংসদের তৃণমূল সদস্য বাবুজন মুর্মু বলেন, “প্রকল্প ঘোষণার পর থেকেই নিম্নমানের চাল দেওয়া হচ্ছে। এলাকার লোকেরা আমার কাছে অভিযোগ করায় বিষয়টি জেলা খাদ্য নিয়ামক দফতরের নজরে আনা হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভাল চাল দেওয়া হচ্ছে না।” মুরারই ১ ব্লকের মহুরাপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের বেলগড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা বলাই মুর্মু বলেন, “কালো এবং ভাঙা চাল দেওয়া হচ্ছে। এই বিষয়ে ব্লকের খাদ্য সরবরাহ দফতরের পরিদর্শককে বলা হয়। তিনি ভাল চাল বিলি করার আশ্বাস দিলেও এখনও তা পাওয়া যাচ্ছে না।”

বলাইবাবুর অভিযোগ, গোটা বিষয়টির জন্য দায়ি সংশ্লিষ্ট রেশন ডিলাররা। বলাই মুর্মুর অভিযোগ মানতে নারাজ পশ্চিমবঙ্গ এমআর ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের বীরভূম জেলা সম্পাদক রবিলাল দাস। তিনি বলেন, “আমরা ডিস্ট্রিবিউটর পয়েন্ট থেকে যে ধরনের চাল পাচ্ছি তাই উপভোক্তাদের দেওয়া হচ্ছে।” খারাপ মানের চালের বিষয়টি নিয়ে তাঁরা জেলাশাসক এবং খাদ্য সরবরাহ দফতরের জেলা নিয়ামকের কাছে একাধিকবার অভিযোগ করেছেন, দাবি করেন তিনি।

রেশন ডিলারদের অভিযোগের কথা স্বীকার করে বাপ্পাদিত্যবাবু বলেন, “মহম্মদবাজার ব্লকের বিডিও রেশন ডিলারদের অভিযোগের বিষয়টি জানিয়েছিলেন। আমি ব্যবস্থা নিয়েছিলাম। এর পরে আর কোনও অভিযোগ ডিলার এবং বিডিওদের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি।” নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন তিনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

apurba chattapadhyay ration wheat
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE