ফোনটা এসেছিল ঠিক পৌনে আটটায়। এক বন্ধু জানাল, তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়। ট্রেন অবরোধ শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রায় আধা তৈরি অবস্থাতেই প্ল্যাটফর্মে পৌঁছই। গিয়ে শুনলাম, সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে গোবরডাঙা স্টেশনে পৌঁছয় শিয়ালদহমুখী ডাউন মাতৃভূমি লোকাল। প্রতিটি কামরার গেটেই ছিলেন আরপিএফ জওয়ানরা। কোনও কোনও গেটে দু’জন করে ছিলেন। গোবরডাঙা প্ল্যাটফর্মে তখন অনেক পুরুষ যাত্রী দাঁড়িয়ে। কেউ কেউ গত এক সপ্তাহের মতো ওই ট্রেনই ধরবেন। কেউ বা পরের মাঝেরহাট লোকাল। কিন্তু, নিরাপত্তারক্ষীদের কড়া নজরদারির চোটে মাতৃভূমি লোকালে উঠতে পারেননি কেউই। ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই গোটা ভিড়টা গিয়ে জড়ো হয় লাইনের উপর। শুরু হয় অবরোধের তোড়জোড়।
এর মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ডাউন মাঝেরহাট লোকালের খবর হয়। সেটি গোবরডাঙা পৌঁছয় ৭টা ৫৫ নাগাদ। অন্য দিনের মতো দু’নম্বর প্ল্যাটফর্মে নয়, বনগাঁ থেকে আসা ট্রেনটি এক নম্বরে আসে। ট্রেন অন্য প্ল্যাটফর্মে আসছে বলে অবরোধকারীরা এ বার এক নম্বর লাইনে গিয়ে জড়ো হন। লাইনের উপর তুলে দেওয়া হয় স্লিপার। ট্রেন থামতেই তার সামনের কাউ ক্যাচার এবং বাম্পারের উপর উঠে পড়েন তাঁরা। প্ল্যাটফর্মে মহিলা যাত্রীদের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। ‘লেডিজ স্পেশ্যাল’ বন্ধ করার দাবি কাগজে লিখে সেগুলি আঠা দিয়ে লাগিয়ে দেওয়া হয় ট্রেনের সামনের উইন্ড স্ক্রিনে। ভিড়টা ক্রমেই বাড়তে থাকে। ইতিমধ্যেই হোয়াটস্অ্যাপে-ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে অবরোধ চিত্র। খবর এল হাবরাতে আটকে দেওয়া হয়েছে মাতৃভূমি লোকালকে। তার ছবিও আসতে শুরু করে। সঙ্গে ফোনও।
এ বার সেই চিন্তাটা মাথায় ঘুরতে শুরু করল, অফিস যাব কী ভাবে? গোবরডাঙা এমন একটি জায়গা যেখানে ট্রেন বন্ধ মানে বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ কার্যত স্তব্ধ। আগের সপ্তাহে বুধবার একই ঘটনা ঘটে। সে দিনও রেল অবরোধের কারণে দু’ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে ছয় ঘণ্টায় কলকাতা পৌঁছেছিলাম। প্ল্যাটফর্মে দেখা হওয়া এক বন্ধুকে বললাম, ‘‘চল, বেরিয়ে পড়ি।’’ ও বলল, ‘‘কী ভাবে?’’ জানালাম, সেটা এখানে বসে বলা সম্ভব নয়। প্ল্যাটফর্ম থেকে নামতে যাচ্ছি, অবরোধকারীদের চিত্কার চেঁচামেচিকে ছাপিয়ে ভেসে এল জোরে জোরে হাততালির শব্দ। দেখি, ট্রেনের ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে হাতে তালি দিয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন দুই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। দাবি, ‘লেডিজ স্পেশ্যাল’ তুলে দিতে হবে। কারণটাও বড় অদ্ভুত। মহিলারা নাকি ওঁদের পয়সা দিতে চান না।
রাস্তায় এসে বেশ কয়েকটি অটো রিকশা দেখতে পেলাম। কেউ গাইঘাটা যাবেন, তো কেউ ঠাকুরনগর। যাত্রীও হচ্ছে। কিন্তু, আমাদের তো প্রথমে হাবরা অবধি পৌঁছতে হবে। প্রায় ১৫ কিলোমিটারের ওই রাস্তার একাংশ খুবই খারাপ। কেউ যেতে রাজি না হওয়ায়, একটা টোটো ধরলাম। মাথা পিছু ১৫ টাকায় পৌঁছলাম চার কিলোমিটার দূরের নকপুলে। সেখান থেকে মছলন্দপুরের দিক থেকে আসা হাবরাগামী গাড়ি পাওয়া যায়। প্রায় ৪৫ মিনিট অপেক্ষার পর ডিএন ১২-এ রুটের একটি বাস এল। ভিতর, পাদানি তো ছেড়েই দিলাম, বাসের পিছনের সিঁড়ি বেয়ে তার মাথাতে ওঠার জায়গাও নেই। ছেড়ে দিতে বাধ্য হলাম। এর প্রায় মিনিট ১৫ পর একটি ছোট গাড়ি এল। অথচ হাবরা যাব বলে আমরা প্রায় পঞ্চাশ জন দাঁড়িয়ে আছি। যে যে রকম ভাবে পারে, লাফিয়ে সেই ছোট গাড়িতে সেঁধিয়ে গেলাম। পরে দেখলাম মাত্র আট জন ভাগ্যবান সুযোগ পেয়েছেন। আমার বন্ধুও রয়েছে দলে।
রাস্তার নানা চড়াই উত্রাই পেরিয়ে এগোলাম হাবরার দিকে। ৪৫ মিনিট পর যখন হাবরা স্টেশনের মুখে যশোহর রোডে নামলাম, চার দিকে তখন লোকে লোকারণ্য। তারই মধ্যে নেমে কোনও রকমে এগিয়ে গেলাম প্ল্যাটফর্মের দিকে। যদি ট্রেন চলালচল শুরু হয়। লোকের মুখে শোনা আর নিজের চোখে দেখা! প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে যা দেখলাম, তা অবিশ্বাস্য। এক নম্বর এবং দু’ নম্বর প্ল্যাটফর্মে দু’টি ট্রেন দাঁড়িয়ে। দু’নম্বরে সেই মাতৃভূমি লোকালটি। গোটা প্ল্যাটফর্মে ছড়িয়ে রয়েছে কাচ। এক নম্বরে দাঁড়িয়ে থাকা আপ ট্রেনটির ট্রেনের দরজা-জানলা সব ভাঙা। এমনকী, সামনের উইন্ড স্ক্রিন পাথরের আঘাতে ক্ষত বিক্ষত। তখনও ছোড়া হচ্ছে পাথর। যাত্রী বিক্ষোভের এমন হাল দেখে থতমত খেয়ে গেলাম। রেল পুলিশ বা হাবরা থানার পুলিশ কোথায় গেল? তখনই জোরাল আওয়াজটা ট্রেনের সামনে থেকে ভেসে এল। দৌড়ে সে দিকে গিয়ে দেখি, লেডিজ স্পেশ্যাল থেকে এক মহিলাকে নামিয়ে বেধড়ক মারধর করা হচ্ছে। সকলেই পুরুষ। তবে, এক জন মহিলাও আছেন। মার খেতে খেতে মহিলা দৌড়ে পালাচ্ছেন। দুই থেকে এক নম্বরে নামলেন। আর তখনই তাঁর উদ্দেশে ছুটে এল বেশ কয়েকটা পাথর। ভিড়টাও তখন দৌড়চ্ছে তাঁর পিছনে। কী করেছেন উনি? ভিড়ের জবাব দেওয়ার দায় নেই। তবে, যেটুকু বুঝলাম, ওই মহিলা বোধহয় কোনও অবরোধকারীর গালে চড় মেরেছেন। বন্ধুকে বললাম, ‘‘চল, এখানে আর এক মুহূর্ত নয়।’’
যশোহর রোডে এসে বারাসতের বাসের আশায় দাঁড়িয়ে থাকলাম। কোনওটাতে পা রাখার যো নেই। একটাতে পা ঠেকিয়েও নামিয়ে নিতে বাধ্য হলাম। ঠিক এমন সময় একটি সিটিসি-র বাস এল। তখন বেলা সাড়ে ১১টা। কোনও রকমে সেটিতে ঠেলে-গুঁতিয়ে উঠলাম। শামুকের গতিতে এগোতে এগোতে সেটি আধ ঘণ্টা ধরে পরের স্টেশন অশোকনগর পৌঁছল। ঘড়িতে ১১টা ৫৫। রেল গেটের আগেই থেমে গেল বাস। সামনে বিপুল জ্যাম। মিনিট ১৫ বাসেই দাঁড়িয়ে থাকলাম। তার পর নেমে এলাম। গরমে ভিতরে দাঁড়ানো যাচ্ছে না। সামনের জ্যাম ঠেলে হাঁটতে হাঁটতে রেল গেটের কাছে পৌঁছলাম। এখানেও সকাল থেকে অবরোধ চলছিল। কিন্তু, এখন ভিড়টা নেই বললেই চলে। যশোহর রোড আটকে গেট পড়ে আছে। কেবিন-ম্যানের কাছে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘গেট কেন পড়ে আছে দাদা? ট্রেন চলবে নাকি?’’ উনি বললেন, ‘‘হ্যাঁ। একটা আপ ট্রেনকে উল্টোপথে ঘুরিয়ে শিয়ালদহমুখী করা হচ্ছে।’’ এর পর আর কিছু ভাবার নেই। রেললাইন ধরে দৌড়তে দৌড়তে পৌঁছলাম স্টেশন। ট্রেনটা তখন সবে হর্ন দিয়েছে। লাফিয়ে উঠে পড়লাম। ছেড়েও দিল।
দমদম যখন নামলাম, তখন সওয়া একটা। ১টা ২৬-এর মেট্রোয় চেপে চাঁদনিচক যখন নামলাম তখন সেই পৌনে দু’টো। দু’ঘণ্টার রাস্তা এ দিন আবারও ছ’ঘণ্টা লাগল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy