অয়ন শীল। নিজস্ব চিত্র।
পুরসভার দোতলায় জনগণকে সাহায্য করা সংক্রান্ত (মে আই হেল্প ইউ) ঘরে টিনের বাক্সে জমা পড়ত সমস্ত আবেদনপত্র। কিন্তু সব যোগ্য আবেদনকারী চাকরির পরীক্ষায় ডাক পেয়েছিলেন, তা নয়। এবং অভিযোগ, যাঁরা ডাক পাননি, তাঁদের বিপুল সংখ্যক আবেদনপত্র রাতে বাক্সে ভরে ফেলে দেওয়া হয়েছিল মাঝ গঙ্গায়!
পুরসভায় নিয়োগ নিয়ে অয়ন শীলের দুর্নীতির তালিকায় থাকা পানিহাটি পুরসভার বিরুদ্ধে এ বার এমনই অভিযোগ উঠছে। ওই পুরসভার অন্দরেই এখন বছর কয়েক আগের ঘটনা নিয়ে ফের চর্চা শুরু হয়েছে। যদিও, স্থানীয় এক ‘প্রভাবশালী’ নেতার আতঙ্কে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে রাজি নন কেউ। তবে প্রাক্তন তৃণমূল কাউন্সিলর (বর্তমানে বিজেপি নেতা) কৌশিক চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বোর্ড মিটিংয়ে বলা হয়েছিল, একটি বেসরকারি সংস্থাকে দিয়ে নিয়োগের পরীক্ষা নেওয়া হবে। তখন আমরা কয়েক জন প্রশ্ন করেছিলাম, কেন চুঁচুড়ার সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হবে? যদিও কর্তৃপক্ষ কোনও উত্তর দেননি। উল্টে জেনেছিলাম, কয়েক হাজার আবেদনপত্র একসময় গঙ্গায় ফেলে দেওয়া হয়েছিল।’’ তাঁর আরও দাবি, ‘‘অয়ন শীলের নাম জানতাম না। কারণ, উনি পুরোপুরি এক নেতার নিয়ন্ত্রণে ছিলেন। নিয়োগের বিষয়ে আমাদের কাউকে কিছু বলা হত না।’’
উত্তর ২৪ পরগনার বিভিন্ন পুরসভার অন্দরের খবর, ৪০-৪৫ হাজার আবেদনপত্র জমা পড়লেও তা থেকে গুটিকয়েক বেছে নিতেন অয়ন। এর সঙ্গে থাকত নিজের তালিকা এবং কতিপয় কাউন্সিলরের কোটায় থাকা প্রার্থী। এই কয়েক জনকেই ডাকা হত পরীক্ষায়। সূত্রের খবর, এমনই হয়েছিল পানিহাটিতেও। ২০১৬ সালে সেখানে কর্মী নিয়োগের অনুমোদন দেয় ডিএলবি। এর পরে ২০১৭-তে আবেদনপত্র জমা হয়। নিয়ম ছিল, সরাসরি পুরসভায় এসে আবেদনপত্র জমা দিতে হবে। স্থানীয়েরা জানাচ্ছেন, প্রতিদিন অসংখ্য ছেলেমেয়ে পুরসভার সামনে এসে আবেদনপত্র পূরণ করতেন। তা জমা করতে হত পুরসভার দোতলার ঘরে। অভিযোগ, যে যোগ্য আবেদনকারীদের পরীক্ষায় ডাকা হল না, তাঁদের আবেদনপত্রের প্রমাণ লোপাট করতেই গঙ্গায় ফেলে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। অয়নের কাণ্ড প্রকাশ্যে আসতেই বিষয়টি নিয়ে নতুন করে জল্পনা শুরু হয়েছে।
সূত্রের খবর, ২০১৮ সালের গোড়ায় অয়নের সংস্থার মাধ্যমে পরীক্ষাও হয় পানিহাটি পুরসভাতে। প্রায় ১১৯টি পদের মধ্যে কিছু ছিল পদোন্নতি এবং বাকি ছিল চতুর্থ শ্রেণিতে নিয়োগের। কিন্তু ওই বছরই পুর বোর্ডের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের যে তালিকা অয়নের সংস্থা দিয়েছিল তা অনুমোদন করা হয়নি। এর পরে প্রায় এক বছর মহকুমা শাসক ওই পুরসভার প্রশাসক পদে থাকায় ওই নিয়োগ-তালিকা নিয়ে কিছু হয়নি। ২০১৯ সালের শেষ দিকে আগের পুর বোর্ডের চেয়ারম্যানই প্রশাসকমণ্ডলীর দায়িত্বে বসেন। বছর খানেকের মধ্যে তাঁর মৃত্যু হয়। তখন নতুন প্রশাসকমণ্ডলী দায়িত্বে আসে। অভিযোগ এর পর থেকেই দফায় দফায় ডিএলবি, পুর ও নগরোন্নয়ন দফতরে কর্মী নিয়োগের তালিকার অনুমোদনের জন্য তদ্বির করতে থাকেন পুর কর্তৃপক্ষ। সেই কাজের জন্য স্থানীয় এক ‘প্রভাবশালী’ নেতা-সহ আরও কয়েক জন শীর্ষ স্তরের নেতা রাজ্য প্রশাসনের কাছে সুপারিশ করতে শুরু করেন বলেও অভিযোগ।
সূত্রের খবর, গত ১৪ মার্চ ডিএলবি থেকে পানিহাটি পুরসভায় একটি চিঠি পাঠিয়ে জানানো হয়, যে সব নিয়োগের জন্য তদ্বির করা হয়েছিল, সেগুলির সপক্ষে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা করতে হবে। অভিযোগ, এর পরে সেই কাগজপত্র (মজদুর পদে ৪০ জনকে নিয়োগের তালিকা) এলবি-তে জমা করতে গিয়েছিলেন ওই পুরসভার এক আধিকারিক ও দুই অস্থায়ী কর্মী। সেই সঙ্গে অয়নের সল্টলেকের বাড়িতেও পাঠানো হয় একই তালিকা। ২০ মার্চ অয়নকে গ্রেফতার করার সময়ে সেই তালিকা ইডি পেয়েছে বলেই সূত্রের খবর। পানিহাটির পুরসভার অন্দরে প্রশ্ন, ২০১৮ সালে পানিহাটিতে নির্দিষ্ট ভাবে মজদুর পদের জন্য কোনও পরীক্ষা হয়নি। তা হলে ছয় বছর পরে ৪০ জন মজদুর নিয়োগের বিষয়টি এল কোথা থেকে?
পুরসভার অন্দরের খবর, নিয়ম মেনে নিয়োগ না হলেও ওই তালিকায় থাকা অনেকেই অস্থায়ী কর্মী হিসেবে ইতিমধ্যেই কাজ করছেন ওই পুরসভায়। যাঁদের কোনও প্রকার পরীক্ষা বা বিজ্ঞপ্তি ছাড়া বিভিন্ন সময়ে কাজে নেওয়া হয়েছে। ডিএলবি-তে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাঠানোর কথা স্বীকার করে পুরপ্রধান মলয় রায় বলেন, ‘‘আগে যে পরীক্ষা হয়েছিল, তখনকার তালিকা অনুযায়ী নামের তালিকা পাঠানো হয়েছিল।’’ তাঁর আরও দাবি, ‘‘বছর কয়েক আগে মজদুর পদেও পরীক্ষা হয়েছিল।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy