Advertisement
E-Paper

সাক্ষী বিরূপ, অপর্ণার স্মৃতি ভুলছে গ্রাম

জমি মাফিয়াদের হাত থেকে চাষের জমি জবরদখল বাঁচাতে গিয়ে বুকে গুলি বিঁধে লুটিয়ে পড়েছিলেন অপর্ণা বাগ। দোষীদের শাস্তির দাবিতে সে দিন ফুঁসে উঠেছিল গোটা ঘুঘড়াগাছি গ্রাম। কিন্তু তার চার মাসের মধ্যেই বদলে গিয়েছে ছবিটা। গ্রামেরই চার সিপিএম কর্মীর নামে হস্তান্তর হয়ে গিয়েছে ওই বিতর্কিত জমির মালিকানা। নিহত অপর্ণার পরিবারের অভিযোগ, তাদেরই একজন সাক্ষীদের প্রভাবিত করছেন।

সুস্মিত হালদার

শেষ আপডেট: ১০ মে ২০১৫ ০২:৫১

জমি মাফিয়াদের হাত থেকে চাষের জমি জবরদখল বাঁচাতে গিয়ে বুকে গুলি বিঁধে লুটিয়ে পড়েছিলেন অপর্ণা বাগ। দোষীদের শাস্তির দাবিতে সে দিন ফুঁসে উঠেছিল গোটা ঘুঘড়াগাছি গ্রাম। কিন্তু তার চার মাসের মধ্যেই বদলে গিয়েছে ছবিটা। গ্রামেরই চার সিপিএম কর্মীর নামে হস্তান্তর হয়ে গিয়েছে ওই বিতর্কিত জমির মালিকানা। নিহত অপর্ণার পরিবারের অভিযোগ, তাদেরই একজন সাক্ষীদের প্রভাবিত করছেন। লোভ দেখাচ্ছেন, অপর্ণাহত্যায় অভিযুক্তরা ছাড়া পেলে ওই জমি গ্রামবাসীদের নামে রেজিস্ট্রি করে দেওয়া হবে। খুনের মামলা তুলে নিতেও চাপ দিচ্ছেন ওই নেতা।

একই অভিযোগ সরকার পক্ষের আইনজীবী বিকাশ মুখোপাধ্যায়েরও। তিনি বলেন, ‘‘যে জমি নিয়ে এত কাণ্ড, সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর ছ’দিন আগে তা গ্রামেরই চার জনের নামে হস্তান্তর হয়ে গেল। জমি রেজিস্ট্রি হওয়ার পরে বাকি আসামিরা আত্মসমর্পণ করল। এতেই প্রমাণ হয়, বোঝাপড়ার পরেই ওরা আত্মসমর্পণ করেছে।’’

প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে খুনের অভিযোগ দায়ের করেছিলেন যে ব্যক্তি, সেই দীপঙ্কর বিশ্বাস সম্প্রতি আদালতে দাঁড়িয়ে বলেন, পুলিশের লেখা বয়ানে তিনি সই করেছেন। মিথ্যা সাক্ষ্যর জন্য কৃষ্ণনগর জেলা আদালত তাঁকে কোর্ট হেফাজতে নেয়। পরে জামিন পান তিনি।

কেন এমন ভোলবদল? দীপঙ্কর বিশ্বাস বলছেন, ‘‘আগে যদি জানতাম আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার হ্যাপা পোয়াতে হবে, তা হলে পুলিশের কথায় কিছুতেই সই করতাম না।’’ যা শুনে অপর্ণার বড় মেয়ে দেবিকা বলেন, ‘‘মা কি শুধু আমাদের জমি বাঁচাতেই ছুটে গিয়েছিল? সে তো সকলের জন্য প্রাণ দিল। আজ সকলে মাকে ভুলে যেতে বসেছে।’’

ঘুঘড়াগাছির ২২ বিঘা জমি দীর্ঘদিন চাষ করতেন গ্রামের ৫৬টি পরিবার। অভিযোগ, তৃণমূল-আশ্রিত দুষ্কৃতী লঙ্কেশ্বর ঘোষ ওরফে লঙ্কা তার দলবল নিয়ে ওই জমি দখল করতে আসে গত বছর ২৩ নভেম্বর। তাঁদের রুখতে গিয়ে মারা যান অপর্ণা বাগ (৩৭)। পুলিশ ২৬ জনকে সাক্ষী করে চার্জশিট জমা দেয়। এ বছর ২৭ এপ্রিল শুরু হয় মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ। প্রথম দিনই সাক্ষী বিরূপ হওয়ার পর সাক্ষ্যগ্রহণ বন্ধ আছে।

কেন এমন হল? গ্রামবাসীদের একাংশ জানালেন, সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হওয়ার দিন কয়েক আগে কিছু চাষি, মামলার সাক্ষী ও কয়েকজন সিপিএম কর্মী এক বৈঠকে বসেন। অপর্ণা বাগের স্বামী দেবানন্দবাবু ও ভাসুর মন্টুবাবুকেও ডাকা হয়। মন্টুবাবু বলেন, ‘‘বৈঠকে ঠিক হয়, লঙ্কা-সহ অন্য আসামীরা ছাড়া পেলে নগদ টাকা-সহ ওই জমি সকলের নামে রেজিস্ট্রি করে দেওয়া হবে। অনেকেই এই প্রস্তাবে রাজি হলেও আমরা হইনি।’’ বৈঠকের কথা স্বীকার করেছেন গ্রামেরই বাসিন্দা, জয়ঘাটা গ্রাম পঞ্চায়েতের সিপিএম সদস্য প্রবীর বিশ্বাস। তাঁর কথায়, ‘‘আমাকে বৈঠকে ডেকেছিল। গিয়ে দেখি ওরা মিটমাট করতে আলোচনা করছে। আমি বেরিয়ে আসি। ওদের এই উদ্যোগকে সমর্থন করি না।’’

গ্রামবাসীর অভিযোগ, সিপিএম নেতা বিজয় মণ্ডলই সাক্ষীদের প্রভাবিত করে মামলা তুলে নেওয়ার প্রধান উদ্যোগ নিচ্ছেন। ওই জমি যে চার জনের নামে হস্তান্তর হয়েছে, তাদের মধ্যে আছেন বিজয়ও। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই জমি ২১ এপ্রিল কৃষ্ণগঞ্জ অ্যাডিশানাল ডিস্ট্রিক্ট সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে বিজয় মণ্ডল, সনাতন মণ্ডল, মান্টু মণ্ডল ও অনিল সরকারের নামে রেজিস্ট্রি করা হয়।

বিজয় ঘটনার পরে অপর্ণা বাগ ও আহতদের পরিবারের পাশে দাঁড়ান। সূর্যকান্ত মিশ্র, বিমান বসুরা যখন গ্রামে যান, তখন বিজয়ের তৎপরতা ছিল তুঙ্গে। ওই জমি জীবন দিয়েও রক্ষা করতে হবে, বলেছিলেন সিপিএমের তাবড় নেতারা। সে জমিই কী ভাবে কিনলেন তিনি?

বিজয়বাবুর উত্তর, ‘‘কম দামে জমিটা বিক্রি হবে শুনে আমরা চার জনে কিনে নিয়েছি। এটা নিয়ে যদি কোনও বিতর্ক হয় তাহলে আমরা লাভ না রেখেই কৃষকদের কাছে জমি বিক্রি করে দেব।’’ কিন্তু মামলা তুলে নিতে বৈঠক ডাকলেন কেন? বিজয়বাবু বলেন, ‘‘আমি গ্রামের দরিদ্র মানুষের পাশে থাকি। তাই আমাকে ওই সভায় ডাকা হয়েছিল। তবে আমি কোনও সিদ্ধান্ত দিইনি।’’

অপর্ণা বাগের বড় মেয়ে নীলিমা অবশ্য বলেন, ‘‘বিজয়কাকু একাধিক দিন আমাদের বাড়িতে এসে জমি আর টাকা নিয়ে মিটমাট করে নিতে বলেছিলেন। কিন্তু কোনও কিছুর বিনিময়ে আমরা মায়ের খুনিদের মাফ করতে পারব না।’’ দেবানন্দবাবুও বলেন, বিজয়বাবুর কথা শুনে অনেকেই মিটমাট করতে চান। কেউ পাশে না থাকলেও তাঁরা একাই লড়াই চালাবেন। জেলার এসপি অর্ণব ঘোষ বলেন, ‘‘আমরা খোঁজ নিয়ে দেখছি, কেন সাক্ষীরা বিরূপ হচ্ছে। আদালতে তা জানিয়েও দিচ্ছি।’’

aparna bag krishnaganj ghughragachhi land movement victim krishnaganj land mafia land mafia
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy