Advertisement
০৫ মে ২০২৪

অন্য কোথাও যেতে চাই না, গুলি করে মারলে তা-ই মাথা পেতে নেব!’

নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে এ-দেশে এসেছিলেন। ভবিষ্যতে কী হবে জানা না থাকলেও তাঁদের এখন একটাই প্রার্থনা, এখান থেকে যেন অন্য কোথাও যেতে না হয়।

মনোযোগ: মায়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অস্থায়ী শিবিরে পাঠরত খুদে পড়ুয়ারা। বারুইপুরের হাড়দহ গ্রামে।

মনোযোগ: মায়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অস্থায়ী শিবিরে পাঠরত খুদে পড়ুয়ারা। বারুইপুরের হাড়দহ গ্রামে।

মেহবুব কাদের চৌধুরী
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০১৮ ০৪:২৭
Share: Save:

ভিটেমাটি ফেলে এসেছেন সুদূর মায়ানমারে। হারিয়েছেন আত্মীয়-পরিজনও। নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে এ-দেশে এসেছিলেন। ভবিষ্যতে কী হবে জানা না থাকলেও তাঁদের এখন একটাই প্রার্থনা, এখান থেকে যেন অন্য কোথাও যেতে না হয়।

কলকাতা থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে বারুইপুরের হাড়দহ গ্রাম। গত ডিসেম্বর থেকে সেখানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে ‘দেশ বাঁচাও সামাজিক কমিটি’ নামে এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। সেই রোহিঙ্গা শিবিরে থাকা লায়লা বেগম বললেন, ‘‘মায়ানমারে আমার শ্বশুর, শাশুড়ি, আব্বা, মা ও এক ছেলেকে মেরে ফেলেছে ও দেশের সেনারা। বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। বছর দে়ড়েক আগে কোনও মতে রাতের অন্ধকারে জলপথে বাংলাদেশে ঠাঁই নিয়েছিলাম। তার পর হরিয়ানা, মথুরা হয়ে এখন বারুইপুরে এসেছি।’’

লায়লার স্বামী সিরাজুল যক্ষ্মায় আক্রান্ত। দুই শিশুপুত্র রায়হান ও ফারহান সবে স্কুলে ভর্তি হয়েছে। লায়লার স্পষ্ট কথা, ‘‘ভিটেমাটি হারিয়ে এখন পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে আর অন্য কোথাও যেতে চাই না। আমাদের গুলি করে মারলে তা-ই মাথা পেতে নেব!’’

সালাউদ্দিন সর্দারের সঙ্গে শিশুরা।

হাড়দহের অদূরেই উত্তর বাঁশড়া গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, একটি দোতলা বাড়ির নীচের তলায় দু’টি ঘরে আশ্রয় নিয়েছে দু’টি পরিবার। আট শিশু-সহ মোট চোদ্দো জন রোহিঙ্গা ওখানে রয়েছেন। মাস তিনেক আগে বাংলাদেশ থেকে দিল্লি হয়ে এক শিশুপুত্র, দুই শিশুকন্যা ও স্বামীকে নিয়ে এখানে এসেছিলেন ফতেমা খাতুন। বললেন, ‘‘মায়ানমারে আমাদের ঘরবা়ড়ি পু়ড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মেরে ফেলা হয়েছে আত্মীয়স্বজনদের। এখন আর কোনও ভাবেই ও-দেশে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। তার চেয়ে বরং এখানে গুলি খেয়ে মরাও ভাল।’’

উত্তর বাঁশড়া গ্রামের তৃণমূলের বুথ সভাপতি সালাউদ্দিন সর্দারের কথায়, ‘‘আমার ভাইপোর বাড়িতে আপাতত তিন মাসের জন্য রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। শীঘ্রই ওঁদের অন্যত্র সরানো হবে।’’

আরও পড়ুন: তুলব চোখ: ঝাড়খণ্ড-মন্ত্রী

মাস পাঁচেক আগে হাড়দহের রোহিঙ্গা শিবিরের সঙ্গে এখনকার ছবির বেশ ফারাক। বাঁশ ও টিনের অস্থায়ী শিবিরে রোহিঙ্গাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে আগেই। এ বার নতুন সংযোজন রোহিঙ্গা শিশু-কিশোরদের শিক্ষাদানের জন্য স্কুল। রোহিঙ্গা শিবিরের অধিকাংশই শিশু ও কিশোর। ওই সব কচিকাঁচার জন্য শিবিরের পাশেই একটি স্কুল তৈরি করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দানকারী সংস্থার সাধারণ সম্পাদক হোসেন গাজি বললেন, ‘‘রোহিঙ্গা শিশুদের সঠিক পরিচয়পত্র না-থাকায় রাজ্য সরকার পরিচালিত স্কুলে ভর্তি করা যাচ্ছে না। যার জন্য আমরা সংস্থার উদ্যোগে একটি স্কুল গড়ে তুলেছি। প্রাথমিক ভাবে চার জন শিক্ষক রেখে আরবি ও বাংলা শেখানো হচ্ছে। তার পর ধাপে ধাপে উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা করব।’’

সপ্তাহখানেক আগে লোকসভায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ বলেছিলেন, সব রাজ্যকে রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। সেই তথ্য হাতে পাওয়ার পরে রোহিঙ্গাদের মায়ানমারে ফেরত পাঠানো হবে।

তা হলে বারুইপুরের অস্থায়ী শিবির-লাগোয়া স্কুল গড়ে তাঁদের স্থায়ী ভাবে আশ্রয় দেওয়াটা কতটা যুক্তিসঙ্গত? এই প্রশ্নের উত্তরে হোসেন গাজির জবাব, ‘‘রোহিঙ্গাদের উৎখাতের কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত আমরা কোনও মতেই মানব না। ওদের পাকাপাকি আশ্রয় দেওয়ার জন্য যত দূর যেতে হয়, যাব। প্রয়োজনে বৃহত্তর আন্দোলনে শামিল হব।’’

কেবল হাড়দহ বা উত্তর বাঁশড়াই নয়। ঘুটিয়ারি শরিফ-লাগোয়া একাধিক গ্রামে বিক্ষিপ্ত ভাবে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছে বলে স্থানীয় সূত্রের খবর। ক্যানিং পশ্চিম কেন্দ্রের তৃণমূল বিধায়ক শ্যামল মণ্ডল বলেন, ‘‘আমার বিধানসভা কেন্দ্রে নারায়ণপুর, বাঁশড়া, শ্রীকৃষ্ণপুর, সাতবিবি, মাকালতলা গ্রামে রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছেন। ভিটেবা়ড়ি হারিয়ে নিজের দেশ ছে়ড়ে কেউ আশ্রয় নিলে আমরা তো তাঁদের মেরে বার করে দিতে পারি না।’’

ঘুটিয়ারি শরিফ-লাগোয়া ফড়িংপাড়ার একটি বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন বৃদ্ধা রুকুন্নেসা বেওয়া। এখানেই থাকবেন কি, জিজ্ঞাসা করাতে বললেন, ‘‘আমার স্বামী ও ছেলেমেয়েদের মায়ানমারেই মেরে ফেলছে। আত্মীয়দের সঙ্গে বাংলাদেশে পালিয়েছিলাম। এখন এখানে কোনও রকমে জীবন কাটাচ্ছি। ওখানে গিয়ে কার কাছে উঠব?’’

জবাব দিতে পারলেন না কেউই।

ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rohingya Myanmar রোহিঙ্গা
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE