Advertisement
E-Paper

শিকড় ছড়িয়ে নানা জেলায়, ক্রমশই বুঝছেন গোয়েন্দারা

ধরা পড়েছে চার জন। সবাই বর্ধমান থেকে। সেখানে খোঁজ চলছে আরও আট জনের। কিন্তু খাগড়াগড় বিস্ফোরণের তদন্তে নেমে নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, এবং বীরভূম জেলাতেও বেশ কয়েক জনের খোঁজ করছে পুলিশ। সব মিলিয়ে গোয়েন্দারা বুঝতে পারছেন খাগড়াগড়ের আইইডি (ইম্প্রোভাইজড্ এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) চক্রের শিকড় অনেকটা দূর পর্যন্ত ছড়ানো ছিল। একটি সূত্রে তাঁরা জেনেছেন, খাগড়াগড়ের মতো অস্ত্র ও বিস্ফোরকের ‘গবেষণাগার’ আরও অন্তত তিনটি জেলায় রয়েছে।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:০৪
ভবানী ভবনে হাসেম মোল্লা। ছবি: সুমন বল্লভ

ভবানী ভবনে হাসেম মোল্লা। ছবি: সুমন বল্লভ

ধরা পড়েছে চার জন। সবাই বর্ধমান থেকে। সেখানে খোঁজ চলছে আরও আট জনের। কিন্তু খাগড়াগড় বিস্ফোরণের তদন্তে নেমে নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, এবং বীরভূম জেলাতেও বেশ কয়েক জনের খোঁজ করছে পুলিশ। সব মিলিয়ে গোয়েন্দারা বুঝতে পারছেন খাগড়াগড়ের আইইডি (ইম্প্রোভাইজড্ এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) চক্রের শিকড় অনেকটা দূর পর্যন্ত ছড়ানো ছিল। একটি সূত্রে তাঁরা জেনেছেন, খাগড়াগড়ের মতো অস্ত্র ও বিস্ফোরকের ‘গবেষণাগার’ আরও অন্তত তিনটি জেলায় রয়েছে।

খাগড়াগড়-কাণ্ডে অন্যতম অভিযুক্ত মঙ্গলকোটের কুলসুনো গ্রামের আবুল কালাম। মঙ্গলকোটের শিমুলিয়া গ্রামে যে অননুমোদিত মাদ্রাসায় বিস্ফোরণ-কাণ্ডে অন্যতম অভিযুক্ত আলিমা বিবি পড়ত, আবুল কালাম সেখানে পড়াত। জেরায় গোয়েন্দারা জেনেছেন, ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত রাজিয়া বিবি এবং আলিমারা ওই মহিলা মাদ্রাসায় জেহাদিদের জন্য নির্দিষ্ট প্রশিক্ষণও দিতে যেত। মঙ্গলবার শিমুলিয়ায় অভিযান চালায় পুলিশ। কিন্তু কারও দেখা মেলেনি।

বৃহস্পতিবার খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণ হয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের দাবি, শুক্রবার পর্যন্ত কালাম এলাকায় ছিল। তার পর থেকে সে বেপাত্তা। রবিবার তার বাড়িতে তল্লাশি চালায় পুলিশ। বাড়ির লোকজন পুলিশের কাছে দাবি করেন, কালামের সঙ্গে বেশ কয়েক বছর পরিবারের কোনও সম্পর্ক নেই। যে আবাসিকেরা শিমুলিয়া গ্রামের ওই মাদ্রাসায় থাকত, তারা জিনিসপত্র নিয়ে চলে গিয়েছে বলে পুলিশ জানায়। মাদ্রাসাটি স্থানীয় যে বাসিন্দার জমিতে, সেই বোরহান শেখও পলাতক। তাকে খুঁজছে পুলিশ। মাদ্রাসার আর এক শিক্ষকেরও খোঁজ চলছে।

পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, খাগড়াগড়ের যে বাড়িটিতে বিস্ফোরণ ঘটে, তা থেকে কয়েক মিটার দূরে যে অনুমোদনহীন মাদ্রাসা রয়েছে, বিস্ফোরণের পর থেকে সেখানকারও পাঁচ শিক্ষার্থী নিখোঁজ। ওই দিনের ঘটনায় মৃত শাকিল আহমেদের মোবাইলের ‘কল লিস্ট’ থেকে ওই পাঁচ জনের খোঁজ মেলে। তার পরে জানা যায়, তারা ওই এলাকার একটি অননুমোদিত মাদ্রাসায় থাকত। গোয়েন্দাদের অনুমান, পাঁচ জনের মধ্যে দু’জন বাংলাদেশে চলে গিয়েছে। বাকিদের খোঁজ চলছে।

বিস্ফোরণস্থল এবং ধৃতদের মোবাইল থেকে পাওয়া সিম-কার্ডের ‘কল ডিটেল্স রেকর্ড’ নিয়েও তদন্ত শুরু করেছে সিআইডি। খাগড়াগড় কাণ্ডে গ্রেফতার হওয়া হাসেম মোল্লাকে এ দিন ভবানী ভবনে এনে জেরা করেন সিআইডি-র গোয়েন্দারা। বিস্ফোরণের দিন শাকিলের মোবাইল থেকে হাসেমকে বেশ কয়েক বার ফোন করা হয়েছিল এবং হাসেমের কাছ থেকে ফোনও এসেছিল বলে গোয়েন্দাদের দাবি। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পরে হাসেম জঙ্গি কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত বলেই মনে করেছে সিআইডি।

বাজেয়াপ্ত হওয়া সিম কার্ডগুলির মধ্যে একটি সিম-কার্ড এক মহিলার নামে রয়েছে বলে জানতে পেরেছেন গোয়েন্দারা। বিস্ফোরণের পরে পরে ওই সিম-কার্ডটি মুর্শিদাবাদ, নদিয়া এবং বর্ধমানের বিভিন্ন জায়গায় ব্যবহার করা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। ওই মহিলাকে চিহ্নিত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন সিআইডি অফিসারেরা।

পুলিশ সূত্রের খবর, খাগড়াগড় বিস্ফোরণের ঘটনা জানাজানি হওয়ার পরেই নদিয়ার করিমপুরের বারবাকপুর গ্রামের বাড়িতে থাকছেন না স্থানীয় বাসিন্দা (রাজিয়া বিবির আত্মীয়) রফিকুল গাজি। এ দিন আনন্দবাজারের প্রতিনিধির মোবাইলে ফোন করে জনৈক ব্যক্তি দাবি করেন, তিনি রফিকুল গাজি। তিনি বলেন, সংবাদমাধ্যমে করিমপুরে শাকিলের ‘আশ্রয়দাতা’ হিসেবে নিজের নাম দেখেই তিনি পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাঁর দাবি, বারবাকপুর গ্রামে পোশাক বিক্রি করতে আসার সুবাদেই প্রায় সমবয়সী শাকিলের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়। শাকিল তাঁকে বলেছিল, তার বাড়ি কলকাতার মেটিয়াবুরুজে। শাকিলের সঙ্গে পরে তাঁর কাকার মেয়ে রাজিয়ার বিয়ে হয়। ওই ব্যক্তির দাবি, “২০০৭ সালে বিয়ের পরে আমাদের এখানে যে ক’দিন ছিল তখনই শাকিলের আসল চেহারা বুঝতে পারি। ও জেহাদ ও ইসলাম ধর্মের জন্য লড়াইয়ের কথা বলত। সেটা জেনেই করিমপুর থানায় বিষয়টি জানাই। ওর সঙ্গে সম্পর্কও শেষ করে দিই।” করিমপুর থানা অবশ্য রফিকুলের কাছ থেকে শাকিল সংক্রান্ত কোনও তথ্য আগে পাওয়া গিয়েছিল বলে মনে করতে পারেনি। তাদের বক্তব্য, কিছু বলার থাকলে রফিকুল যে কোনও সময় থানায় আসতে পারেন।

রফিকুলের সন্ধানে না হলেও সিআইডি-র একটি দল এ দিন বারবাকপুরে গিয়েছিল। তারা গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্য তৃণমূলের হাসান আলি মণ্ডল, রাজিয়ার পিসি আনোয়ারা বেওয়া ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে। একই ঘটনার তদন্তে মুর্শিদাবাদের বেলডাঙার নেদেরঘাট এলাকায় গিয়েছিল আইবি-র দল। স্থানীয় বাসিন্দা তথা শাকিলের পরিচিত ইউসুফ নামে এক জনের সঙ্গে কথা বলেন তাঁরা। ইউসুফ এক সময় বোরখার কারবার চালাতেন। সেই সূত্রেই শাকিলের সঙ্গে আলাপ। তিনিই ঘরভাড়া নিয়ে শাকিলকে থাকতে দেন। নবগ্রামের তালগড়িয়া গ্রামের আলিমা বিবির পরিবারকেও জেরা করেন গোয়েন্দারা। প্রথমে তিন সিআইডি অফিসার। পরে জেলা গোয়েন্দা দফতরের দু’জন। আলিমার দাদা আলম হোসেন বলেন, “বর্ধমানের মাদ্রাসায় আলিমাকে ভর্তি করার পিছনে কোনও কারণ ছিল কি, বিয়ের পরে আলিমা এলে, তখন অপরিচিত কেউ দেখা করতে আসত কি নাএ সবই ওঁরা জানতে চান।”

খাগড়াগড়ের ঘটনাস্থলে এ দিন যান কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা দলের (সেন্ট্রাল আইবি) প্রতিনিধিরা। তারা বেরিয়ে যেতে সেখানে যায় সিআইডি-র দল। সিআইডি বর্ধমান আদালতে জানায়, বিস্ফোরণে জখম আব্দুল হাকিম ওরফে হাসানকে ধরা হয়েছে। সুস্থ হলে তাকে আদালতে আনা হবে। ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত কউসরের খোঁজে বর্ধমান শহর ও লাগোয়া এলাকায় তল্লাশি চালায় পুলিশ।

বিস্ফোরণে আর এক নিহত স্বপন মণ্ডল ওরফে সুবহানের পরিচয় জানতে এ দিন পূর্ব মেদিনীপুরেও তৎপরতা শুরু হয়েছে। গোড়া থেকেই শোনা যাচ্ছে সুবহান পূর্ব মেদিনীপুরের উত্তরপাড়ার বাসিন্দা। জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, এ দিন রাজ্য গোয়েন্দা দফতর থেকে তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে পূর্ব মেদিনীপুরে উত্তরপাড়া নামে কোনও এলাকা রয়েছে কিনা। জেলার কোনও বাসিন্দার নাম সুবহান মণ্ডল কি না, তা-ও জানতে চাওয়া হয়েছে। এই নির্দেশ পেয়ে জেলা পুলিশ প্রতিটি থানাকে এলাকার গ্রামগুলির নামের তালিকা তৈরি করতে বলেছে।

নানা ধরনের সূত্র জেলায় জেলায় ছড়িয়ে থাকলেও তদন্ত যত এগোচ্ছে, ততই খাগড়াগড়ের ঘটনার সঙ্গে জামাতুল মুজাহিদিনের যোগাযোগ স্পষ্ট হচ্ছে বলে দাবি তদন্তকারীদের। সিআইডি-র এক কর্তার কথায়, “প্রাথমিক তদন্তে এটা স্পষ্ট, শাকিলদের কার্যকলাপ চালিয়ে যাওয়ার জন্য নিয়মিত অর্থের জোগান ছিল। কিন্তু তা কোথা থেকে আসত, সেটাই আমরা জানার চেষ্টা চালাচ্ছি।”

burdwan blast khagragarh khagragadh jamat shakil ahmed hasem mollah
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy